বেশ কয়েকজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ায় এর সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণার পর কার্যত বিচ্ছিন্ন শিবচর উপজেলা। প্রশাসনের ওই ঘোষণার পর খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রাখতে শুক্রবার দুপুরের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শিবচরের চারটি এলাকার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন উপজেলাবাসী।
মাদারীপুর স্বাস্থ্য বিভাগ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে শিবচর উপজেলাকে। এ নিয়ে আতঙ্কিত মাদারীপুরের অন্য উপজেলার মানুষও।
এদিকে করোনা আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন কয়েক গুণ। তবে, মাদারীপুর প্রশাসন বলছে, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বাজার-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ রাখা হবে।
জানা গেছে, শিবচর উপজেলায় প্রবাসী রয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার। গত ১৫ দিনে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৬৬৪ জন প্রবাসী এসেছেন শিবচরে, যার অধিকাংশই করোনায় বিপর্যস্ত দেশ ইতালিফেরত। প্রবাসীদের আনাগোনা বেশি থাকায় এবং প্রবাসীরা হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে না চলার কারণে ঝুঁকিতে চলে আসে মাদারীপুরের এ উপজেলা। ফলে লকডাউন ঘোষণা করে ঝুঁকিপূর্ণ চারটি এলাকাকে প্রশাসনের বিশেষ নজরদারিতে নেয়া হয়। মোতায়েন করা হয়ছে অতিরিক্ত পুলিশ।
বৃহস্পতিবার এমন ঘোষণার পর মানুষের ঘর থেকে বের হওয়া কমে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানপাট ছাড়া উপজেলার সব ধরনের রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকান বা এমন কোনো স্থান যেখানে মানুষের সমাগম হতে পারে সেগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। শিবচরের ভেতরে গণপরিবহনের চলাচলও বন্ধ রাখা হয়েছে।
শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেখা গেছে, গোটা শিবচরে মানুষের চলাচল ছিল অনেক সীমিত। প্রয়োজনীয় বাজার করা ছাড়া কাউকে সেভাবে বের হতে দেখা যায়নি। ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কাশি শিষ্টাচার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেটা মাইকিং করে, লিফলেট বিতরণ করে, পোস্টার টানিয়ে এবং মসজিদের ইমামের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী ১৫ দিন বাসিন্দাদের সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। হটলাইনের মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, চলাফেরায় বিধি-নিষেধের ফলে রাস্তাঘাট ফাঁকা রয়েছে। কাউকে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতি তাারা কখনো দেখেননি বলে জানান শিবচরের বাসিন্দারা। বাঁচামারা গ্রামের আব্দুর রহিম, আয়েশা বেগমসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউই বের হচ্ছেন না। সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছে। ছেলেমেয়েদের স্কুল-মাদ্রাসা বন্ধ হয়া গেছে। তাদের খেলতে যেতেও দেয়া হচ্ছে না।
সস্প্রতি ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ শিবচরকে করোনাভাইরাসে সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিকের ঘোষণার পর শিবচর উপজেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থানে যায়। হোম কোয়ারেন্টাইন না মানলে আইনগত ব্যবস্থার কথা জানানো হয়।
এদিকে হোম কোয়ারেন্টাইন না মানা ব্যক্তিদের জন্য শিবচর নন্দকুমার ইনস্টিটিউশকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হিসেবে প্রস্তুত রাখা হবে জানিয়েছে প্রশাসন। করোনাভাইরাসের কারণে উপজেলার দুটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার দুটি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। ওই সব এলাকার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ গতিরোধ করবে পুলিশ। এ জন্য প্রায় ২৫০ জন অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে জনসমাগম এড়াতে যেখানে সেখানে অবাধ বিচরণ ও প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার জন্য স্থানীয়দের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়া যাতে কেউ বাড়ি থেকে বের না হয় সে দিকে বিশেষ লক্ষ রাখা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো বিশেষ নজরদারিতে রাখা হবে।’
ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, শিবচরের ওই এলাকাগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায়, সেখানে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছি। সেখানকার আক্রান্ত ব্যক্তিরা এই ভাইরাস ছড়াতে পারে তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা সবাইকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য বাধ্য করছি। লকডাউন করা ছাড়া পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব।’
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, মাদারীপুরের চার উপজেলা, চার পৌরসভা ও ৬০টি ইউনিয়নে করোনা প্রতিরোধে কমিটি করেছে প্রশাসন। এছাড়া জেলা প্রশাসন থেকে একটি সেলও গঠন করা হয়েছে।’ এ অবস্থায় সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার আহবান জানান তিনি।
মাদারীপুরের সির্ভিল সার্জন মো. শফিকুল ইসলাম জানান, মাদারীপুর জেলায় সম্প্রতি বিদেশ থেকে ফিরেছে অন্তত তিন হাজারের বেশি মানুষ, যার অধিকাংশই শিবচর উপজেলার বাসিন্দা। যে কারণে এই পর্যন্ত যারা করোনভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তার বেশি ভাগই শিবচরের। তাই হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে চলার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মাদারীপুরে বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছে ২৬৩ জন, ৪ জন আইসোলেশনে ও একজন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারিন্টাইনে আছেন। জেলায় বেশ কজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নূর-ই-আলম মিনা শিবচর পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিবচর উপজেলায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর জনসাধারণের বিশেষ প্রয়োজনে বের হতে হলে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে পুলিশ তাকে সহায়তা করবে।
ইকে/ই-১১:৪৩ মিনিট, ঢাকা