বাজার-সদাই করার সময় ওজন কারচুপি ও প্রতারণার শিকার হয় নি এমন মানুষ খুব কমই আছে। হঠাৎ বড়লোক বা ধনী হওয়ার ধান্ধায় ব্যবসায়ীরা জড়িয়ে যাচ্ছে প্রতারণায়। তাই ওজন কারচুপি বা ওজনে কম দেওয়া ও মানুষকে ঠকানো অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য বর্তমানে নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত: আমরা ভোক্তা সাধারণের সামান্য অসতর্কতার সুযোগে কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী এধরণের অপকর্ম দিনের পর দিন করে আসছে। মাঝে মধ্যে তাদের প্রতারণা জনগণের নিকট ধরা পড়লেও সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যবসায়ী সমিতি ও প্রতারকদের সংঘবদ্ধ চক্র বিভিন্নভাবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করা পার পেয়ে যায়, আবার শুরু করে কারচুপি। এমতাবস্থায় ভোক্তাদের সচেতনতা ও আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নাই। সম্প্রতি কাঁচাবাজার করতে গিয়ে কিভাবে আমিও ওজন প্রতারকের খপ্পরে পড়ি এবং কিভাবে তাদের মুখোশ উন্মোচন করেছি তা তুলে ধরার জন্য এ লেখাটির অবতারণা।
বিভিন্ন কাঁচাবাজারে যারা মাছ-মাংস ক্রয় করেন, তাদের জন্য এ সতর্কতা। সাধারণতঃ বাজার-সদাই করার অভ্যাস আমার নাই। ঘটনাক্রমে সম্প্রতি একদা সকালবেলায় বহদ্দারহাটে মুরগি ক্রয় করতে গিয়ে স্বচক্ষে দেখলাম এক অভিনব ওজন কারচুপি! একসময় দাঁড়িপাল্লায় ওজনে নয়-ছয় করা হতো। সময় পাল্টেছে, দেশ আধুনিক হয়েছে, আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে সর্বত্র। বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। তাই এখন বাজারে সাধারণ দাঁড়িপাল্লা চোখেই পড়ে না। ইলেক্ট্রনিক্স/ডিজিটাল স্কেলে চলে ওজনের কাজ-কারবার। এ ডিজিটাল স্কেলে প্রতারণার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু কখনও নিজ চোখে দেখিনি। সেদিন তা দেখলাম।
আমি মুরগির দোকানে গিয়ে বিক্রেতাকে বললাম, ২ কেজি ওজনের মুরগি দিতে। ডিজিটাল স্কেলে দেখলাম ২ কেজির ২৫৫ গ্রাম হলো ও দাম আসল ২৭৬ টাকা। আমার সন্দেহ হওয়ায় মুরগি হাতে নিয়ে দেখলাম, ওজন কম মনে হলেও বুঝতে পারছিলাম না ও কারচুপিও ধরতে পারলাম না। তবে নিশ্চিত ওজনে কম দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রমহিলা এক কেজি ওজনের দু’টি মুরগি দিতে বললেন। আমার সন্দেহ দূর না হওয়ায় আমি স্কেলের দিকেই তাকিয়ে আছি। খেয়াল করলাম, দোকানী মুরগি স্কেলের ঝুড়িতে ডানহাতে মুরগি রাখছেন এবং একইসাথে বাম হাতে সাদা পলিথিন মোড়ানো একটি কাগজ সদৃশ কোন বস্তু ঝুড়ির পাশে রাখতেছে (যা ভালোভাবে না দেখলে বুঝতেই পারবেন না)। মুরগি ওজন করা শেষ হলো, মুরগি স্কেল থেকে নেওয়ার সময় ঝুড়িটি হালকা বাঁকা করার সাথে সাথে পলিথিন মোড়ানো কাগজ সদৃশ্য বস্তুটি স্কেলের পাশে পড়ে গেছে।
আমার সন্দেহ হলে সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বললাম, ওজনে কারচুপি করছেন মনে হয়। দোকানদার অস্বীকার করল। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। এরপর দোকানের ভিতরে গিয়ে স্কেলের উপর থেকে ঝুড়িটি সরিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম, স্কেলের পাশে সাদা পলিথিন মোড়ানো কাগজ সদৃশ্য বস্তুসমূহ হচ্ছে অধুনা বিলুপ্ত দাঁড়িপাল্লার ২৫০ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম ও ১ কেজি ওজনের সিল।
আমি দোকানিকে বললাম, আপনার ডিজিটাল স্কেলের সাথে এই পুরাতন সিলসমূহের কাজ কী?
সে তো কোন উত্তর দিতে পারে না।
আপনি এসব সিল ডিজিটাল স্কেলে দিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণা করছেন কেন? সাথে সাথে তাদের সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয় হয়ে গেল। কয়েকজন এগ্রিয়ে এসে দোকানদারকে চড়-থাপ্পর মেরে দোকান থেকে বের করে নিয়ে গেল।
ভেবে দেখুন, তারা যেভাবে ওজন করছে একজন সাধারণ ক্রেতা বস্তুসমূহ দোকানের বাইরে থেকে দেখলে মনে করবে কাগজ সদৃশ্য কিছু। কিন্তু বুঝতেই পারবেন না যে, কতটুকু তিনি ঠকেছেন বা প্রতারিত হয়েছেন।
এরপর আমার ক্রয়কৃত মুরগি আবারও ওজনের জন্য চ্যালেঞ্জ করলাম। এবার হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল ওজন কারচুপি। ২৭৬ টাকার মুরগির দাম এসেছে মাত্র ১৯৬ টাকা। অর্থাৎ দুই কেজি মুরগি ক্রয় করতে গিয়ে ৮০ টাকা ঠকানো হচ্ছে। একজন মানুষের উপর তা কতবড় জুলুম!
আমার সচেতনতার কারণে হয়তো ঠকানো সম্ভব হয় নি, কিন্তু প্রতিদিন কতশত মানুষ তাদের ফাঁদে পড়ছে। এসব বিষয়ের প্রতিকার প্রয়োজন। আমরা বাঙালি জাতি দিন দিন যেন একপ্রকার ধোঁকাবাজ জাতিতে পরিণত হচ্ছি। একদিকে ফরমালিন মিশ্রিত বিষাক্ত খাবার ও অন্যদিকে ওজনে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও অত্যাধিক মুনাফার আশায় পণ্য মুজুদদারির মাধ্যমে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বেশি মূল্য হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রীতি পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে আমরা দেখেছি, ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ মজুদ করে পচিয়ে ফেলেছে, তবুও বিক্রি করেনি। অথচ, পণ্য মজুদ করে মানুষকে কষ্ট দেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। এভাবেই ব্যবসায়ীরা বিভিন্নভাবে নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে, প্রতারণা করছে।
এখন এসব প্রতারণা থেকে মুক্তির উপায় কী? মনে রাখবেন, সব সমস্যার সমাধান আছে। যেকোন অন্যায় রোধ করার নিশ্চয়ই উপায় আছে। একইভাবে ওজন কারচুপি বন্ধ করতে হলেও আমাদের কিছু বিষয়ে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রথমতঃ ধর্মীয় অনুশাসন। আমরা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। মুসলমান হিসেবে আমাদের ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে ধর্মীয় অনুশাসন পালনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে ইসলাম কী নির্দেশনা দিয়েছে তা জানতে হবে ও জানাতে হবে।
তারীখু বাগদাদ, ১৩ খন্ড, ৩৫৮ পৃষ্ঠায় একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। তা ইমাম আযম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির ঘটনা। যিনি শরীয়তের প্রধান চার ইমামের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তার নামানুসারে হানাফী মাযহাব প্রবর্তিত। বাংলাদেশের প্রায় মুসলমান হানাফী মাযহাবের অনুসারী। মূল কথায় আসি, ঘটনাটি হলো- ইমাম আযম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। তাঁর একজন ব্যবসায়ীক পার্টনার ছিলেন হাফেজ ইবনে আব্দুর রহমান। একদিন তিনি হাফিজকে কিছু কাপড় বিক্রি করতে দেন এবং বললেন এখানে একটা কাপড়ে খুঁত আছে। তিনি জোর দিয়ে বললেন কাপড়টা বিক্রি করার সময় ক্রেতাকে যেন খুঁত সম্পর্কে বলে দেয় হয়। তার অংশীদার কাপড় বিক্রি করার সময় ত্রুটির কথা বলে দিতে ভুলে গেলেন। যখন কথাটা মনে পড়ল তখন কাকে বিক্রয় করেছেন সেটাও আর মনে করতে পারছিলেন না। ইমাম আজম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি এ ব্যাপারটি জানার পর ওই কাপড়ের মূল্য পুরোটাই নিজের কাছে আর রাখলেন না, সাথে সাথে সাথে সাদকাহ করে দিলেন। ব্যাবসায়িক সততাই শতভাগ উত্তীর্ণ তো বটেই, ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা অকাতরে ব্যয় করার ক্ষেত্রেও ইমাম আযম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন অনন্য। প্রতি বছর তিনি মুনাফা জমা করতেন আর সেগুলো বয়োবৃদ্ধ মুহাদ্দিস ও দরিদ্র ছাত্রদের খোরাকি বসন-পরিচ্ছদ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য খরচ নির্বাহের জন্য দান করে দিতেন। আমাদের ব্যবসায়ীগণ যদি এখান থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারতেন। আল্লাহকে ভয় করার শিক্ষাটা যদি গ্রহণ করতে পারতেন। তাহলে তা কতই না মঙ্গলজনক হতো।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,‘এরা এমন লোক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেচাকেনা যাদেরকে ভুলিয়ে রাখতে পারে না আল্লাহর স্মরণ, সালাত কায়েম, যাকাত আদায় থেকে। তারা এমন দিনকে ভয় করে যেদিন মানুষের অন্তর ও দৃষ্টি উলটপালট হয়ে যাবে। যাতে আল্লাহ তাদের কাজের সেরা প্রতিদান দেন এবং স্বীয় অনুগ্রহ থেকে তাদেরকে আরো বেশি দান করেন। আল্লাহ যাকে চান, তাকে কোনো হিসেব ছাড়াই রুজি-জীবিকা দান করেন’। ( আল-কুরআন, সূরা নূর, ২৪:৩৭) একই সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদিসটিও যেন আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে। হাদিস পাকে হযরত রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী থাকবে নাবি, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথেই।’
দ্বিতীয়তঃ শাস্তির ব্যবস্থা। যেসব বিক্রেতা ধর্মীয় বিধান ও দেশের আইন অনুযায়ী নীতি-নৈতিকতা সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য না করে অসদুপায়ের মাধ্যমে ক্রেতা সাধারণকে ধোঁকা দেয় তাদেরকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
তৃতীয়তঃ সচেতনতা। সর্বসাধারণকে সচেতন হতে হবে। ক্রেতারা সচেতন হলে বিক্রেতারা কখনও ধোঁকা দিতে সক্ষম হবে না। একসময় বাজারে সিটি কর্পোরেশনে স্কেল থাকত, মানুষ প্রয়োজনে সেখানে ওজন করে নিশ্চিত হতে পারত। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনের সেসব স্কেল দেখা যায় না। মানুষের সুবিধার জন্য এব্যাপারে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
পরিশেষে বলব, আমার মত অনিয়মিত ক্রেতার সামান্য সচেতনতাই যদি এসব কারচুপি ধরতে পারি। নিয়মিত ক্রেতা সাধারণ আরো সতর্কতার সাথে এসব বিষয় সচেতন থাকেন তবে প্রতারক ব্যবসায়ীরা কাউকে ঠকাতে পারবে না।
লেখক:
প্রাবন্ধিক ও সদস্য সচিব, অর্কিড সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা।
১০, আলিফ বিপনী সেন্টার , আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম।
লাইটনিউজ/এসআই