শনিবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৫২ পূর্বাহ্ন

করোনায় আর্থিক চাপে বিমান

লাইটনিউজ রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার, ২ এপ্রিল, ২০২০

বহরে ১৮টি উড়োজাহাজ। এর সঙ্গে ২১৮ কোটি টাকার নিট মুনাফা। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালে সাফল্য দাবি করেছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। নতুন রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনাও করেছিল রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থাটি। কিন্তু নতুন বছর ২০২০ সালে শুরু থেকে উল্টো পথে চলতে বাধ্য হচ্ছে বিমান। কারণ একটিই করোনাভাইরাস। চীন থেকে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ১২৭৯ কোটি টাকার আর্থিক চাপে পড়েছে বিমান।

বিমানের আয়ের পথে টান:
কেবল টিকিট বিক্রি করে যাত্রী পরিবহন নয়, বিমান অতিরিক্ত ব্যাগেজ চার্জ, কার্গো পণ্য পরিবহন, বাংলাদেশে চলাচলকারী দেশি-বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর পণ্য গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে থাকে বিমান। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো.মোকাব্বির হোসেন জানালেন, ২০১৯ সালে কার্গো পণ্য ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করে ৯০০ কোটি টাকা আয় করেছিল সংস্থাটি। গড়ে প্রতি মাসে ৭৫ কোটি টাকা আয় করত বিমান। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়া, ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৯০ কোটি টাকা আয় করেছে তারা। গড়ে আয় হয়েছে মাসে ৩০ কোটি টাকা। একই ভাবে ২০১৯ সালে বিমান আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটে ২৭ লাখ ৬২ হাজার যাত্রী বহন করেছে। কিন্তু গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে গড়ে বিমানের যাত্রী কমে গেছে ৩৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে বিমানের সামর্থ্যের চেয়ে ১৫ শতাংশ যাত্রী কম ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে ১৬৫৬ ফ্লাইটের মধ্যে বাতিল হয়েছে ১১৪টি। যাত্রী কমেছে ৫৮ শতাংশ। মার্চ মাসে ৬৯৮টি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। এ কারণে গেল মার্চে বিমানের যাত্রী কমেছে ৪৬ শতাংশ।

বিমানের প্রধান কার্যালয়ে মো.মোকাব্বির হোসেন বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে যাত্রী কমে যাওয়ায় আন্ডার লোড ফ্লাইট প্রচুর চালাতে হয়েছে। এ ছাড়া মার্চ মাসে আমাদের কোনো টিকিট বিক্রি হয়নি। উল্টো আগাম টিকিট যাঁরা কেটেছিলেন তাদের টাকা ফেরত দিতে হয়েছে।’

*তিন মাসে যাত্রী কমেছে ৩৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ
* কার্গো হ্যান্ডেলিং ও ব্যাগেজ চার্জ মাসে আয় কমেছে ৫৫ কোটি টাকা
* ১৮টি উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মাসে ২৬৬ কোটি টাকা
* তিন মাসে রাজস্ব আয়ে ক্ষতি ৪০২ কোটি টাকা
*নতুন পাঁচটি রুট নিয়েও অনিশ্চয়তা

বিমান কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭টি গন্তব্যে প্রতি সপ্তাহে ২১৮টি ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। গত ১০ মার্চের পর থেকে বিমানের একের পর এক রুট বন্ধ হয়েছে যেতে থাকে। সবশেষ গত শনিবার ৩০ জানুয়ারি সব শেষ দুটি রুট যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও ম্যানচেস্টারে বিমানের ফ্লাইট বন্ধ হয়েছে যায়। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত এই দুটি রুটে ফ্লাইট চলাচল স্থগিত করে বিমান। অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলছে না বিমানের। এই তিন মাসে টিকিট বিক্রি বাবদ ২৪০ কোটি ১৭ লাখ ফেরত দিতে হবে বিমানকে।

উড়োজাহাজে রক্ষণাবেক্ষণে বড় ব্যয়:
বিমান বহরে বর্তমানে মোট উড়োজাহাজ রয়েছে ১৮টি। এর মধ্যে ২৯৮ আসনের দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯ মডেলের ড্রিমলাইনার, ২৭১ আসনের চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার, ৪১৯ আসনের চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর এবং দুটি ১৬২ আসনের দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মিলিয়ে বিমানের নিজস্ব অর্থে কেনা উড়োজাহাজ রয়েছে মোট ১২টি। বাকি ছয়টি উড়োজাহাজের মধ্যে চারটি ৭৩৭-৮০০ ও ৭৪ আসনের দুটি ড্যাশ-৮ লিজে আনা হয়েছে। এত বেশি উড়োজাহাজ অতীতে কখনো বিমানের বহরে ছিল না। এর সঙ্গে চলতি বছরের জুনের মধ্যে আরও তিনটি নতুন ড্যাশ-৮ কানাডা থেকে বিমান বহরে নাম লেখাবে। তবে করনোভাইরাসের কারণে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিমানের ১৮টি উড়োজাহাজের সবগুলোই ডানা গুটিয়ে বসে আছে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে। আকাশে না উড়ে ডানা গোটানো থাকলেও অত্যাধুনিক উড়োজাহাজগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। আর এ জন্য প্রতি মাসে বিমানের প্রয়োজন হবে ২৬০ কোটি টাকা। বিমানের এমডি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আয় কমেছে। মার্চ মাসে টিকিট বিক্রি হয়নি। কিন্তু বিমানের খরচ যেসব খাতে রয়েছে, সেগুলো কিন্তু রয়ে গেছে। এর মধ্যে ১২টি উড়োজাহাজ বিমানের সম্পদ। এগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে। লিজে আনা বাকি উড়োজাহাজগুলোসহ ১৮টি উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ে এপ্রিল মাসে লাগবে ২৬৬ কোটি টাকা।’

বিমানের এমডি বলেন, লিজ আনা উড়োজাহাজের জন্য এপ্রিলে প্রয়োজন ৯৮ কোটি টাকা। উড়োজাহাজের কিস্তির জন্য ৭০ কোটি টাকা। বিমানের বিশাল কর্মী বহরের বেতন ও বিভিন্ন দেশে অফিস রক্ষণাবেক্ষণ খরচ মাসে ২০৩ কোটি টাকা। এসব কিছুর জন্য এপ্রিল মাসে খরচ ৫৩৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বিক্রি হওয়া টিকিট ফেরত নিয়ে যাত্রীদের দিতে হবে ১৪ কোটি টাকা। এ সঙ্গে গত তিন মাসে রাজস্ব আয়ে ক্ষতি হয়েছে ৪০২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বিমান চলতি বছরের তিন মাসে বিমান ১২শ কোটি টাকার বেশি আর্থিক চাপের মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এই অঙ্ক আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই সার্বিক বিষয় উচ্চপর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে।

ক্ষতি পোষাতে বেতন কর্তন:
রুট ও আয় কমে যাওয়ায় বিমানের সব কর্মকর্তার ওভারটাইম ভাতা প্রদান বাতিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে ষষ্ঠ থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাসহ ককপিট এবং কেবিন ক্রুদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ হারে কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ। গত ২২ মার্চ বিমানের পরিচালক প্রশাসন এ-সংক্রান্ত একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে।

নতুন রুটেও অনিশ্চয়তা:
দুটি মহাদেশের ১৭টি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে বিমান। এর মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের রিয়াদ, মক্কা, মদিনা, দাম্মাম, আরব আমিরাতের আবুধাবি ও দুবাই, ওমানের মাসকাট, কুয়েতের কুয়েত সিটি, কাতারের দোহা। প্রাচ্যের রুটগুলো হচ্ছে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর। দক্ষিণ এশিয়া বিমানের রুট রয়েছে ভারতের কলকাতা ও দিল্লি এবং নেপালের কাঠমান্ডু। ইউরোপে দুটি রুট যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও ম্যানচেস্টার। বহরে উড়োজাহাজ সংখ্যা বেশি থাকায় রুট সম্প্রসারণে পরিকল্পনা করেছিল বিমান কর্তৃপক্ষ। এরই অংশ হিসেবে গত মার্চ থেকে চীনের গুয়াংজুতে ফ্লাইট চালুর কথা ছিল। একই সঙ্গে ভারতের চেন্নাই, শ্রীলঙ্কার কলম্বো, মালদ্বীপের মালে রুটও বিমানের যাত্রা শুরুর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সবই এখন অনিশ্চিত হয়ে গেছে। বিমানের এমডি ও সিইও মোকাব্বির হোসেন বলেন, ‘সিঙ্গাপুর প্রতিদিন সকালে বিমানের একটি করে ফ্লাইট ছিল। এই রুটে প্রতি রাতে আরও একটি ফ্লাইট দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। আমিরাতের শারজায়ও খুব শিগগিরই ফ্লাইট চালু হতো। কিন্তু এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।’

হজ মৌসুমে ২০১৯ সালে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার হজযাত্রী বহন করেছিল বিমান। এবার সেটি নিয়েও অনিশ্চয়তায় রয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ।

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোকাব্বির হোসেন বলেন, হজ ফ্লাইটের শিডিউল করা হয়েছে। প্রস্তুতি রয়েছে বিমানের। এবার হজ ফ্লাইটের জন্য কোনো উড়োজাহাজ লিজ নেওয়া হবে না।

লাইট/এএইচ

Please Share This Post in Your Social Media

আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2020 Lightnewsbd

Developer Design Host BD