শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২৭ অপরাহ্ন

বিশ্বকে মন্দার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা ৩০ দিন

লাইটনিউজ রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০

ফেব্রুয়ারি ১৭। চীনে নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু অন্যান্য দেশে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজারেরও কম। বিনিয়োগকারীরা তখনো জানতেন না পরবর্তী ৩০ দিনে চীনের বাইরে ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে এই মহামারি। ফলে হঠাৎ থেমে গেছে ব্যবসা বাণিজ্য, স্টক মার্কেটে নেমেছে ধস এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ২০০৮ এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার চেয়েও বড় পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে।

বৈশ্বিক মন্দা যা ২০২০ সালে অকল্পনীয় ছিল তাই এখন ঘটতে যাচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে দিয়েছেন এই বৈশ্বিক মহামারি অর্থনীতিকে মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আরও খারাপ সংবাদ হলো মহামারি মাত্র শুরু হয়েছে। এখনো এর তাণ্ডবলীলার আরও অনেক বাকি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকার সুদের হার কমিয়ে আনছে, ঋণ নিশ্চিত করছে এবং নতুন ব্যয় প্রকাশ করছে। ভবিষ্যতের জন্য কার্যকরী অর্থনৈতিক ভিত্তি সংরক্ষণে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে এবং কোম্পানি ও কর্মীদের আশঙ্কা কমাতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

সংকটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প সরকার বিরাট আকারে কর্মী ছাঁটাই ঠেকাতে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বিল পাশ করার জন্য কংগ্রেসকে বলেছে। কারণ বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং এয়ারলাইন্স, হোটেল এবং রেস্টুরেন্টগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।

গত শুক্রবার (২০ মার্চ) যুক্তরাজ্য সরকার জানিয়েছে, মহামারির কারণে কারো চাকরি হারানোর ভয় থাকলে সরকার তার বেতনের ৮০ শতাংশ দিয়ে দেবে। তবে মনে হয় অনেক দেরি হয়ে গেছে। গোল্ডম্যান স্যাকের ধারণা অনুযায়ী এই সপ্তাহে ২ দশমিক ২৫ মিলিয়ন আমেরিকান বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছে। এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংখ্যা।

একইসঙ্গে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯০৬ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ১১ হাজার ৯৪৯ জন। স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য আংশিকভাবে বা পুরোপুরি লকডাউন করা হয়েছে। বিশ্বের ৫ম সর্বোচ্চ অর্থনীতির বড়াই করা ক্যালিফোর্নিয়া তার ৪০ মিলিয়ন নাগরিককে বাড়িতে থাকতে বলেছে।

গোল্ডম্যান স্যাকের প্রধান মার্কিন সাম্য কৌশলী ডেভিড কোস্টিন সিএনএনকে জানান, করোনাভাইরাস অকল্পনীয় আর্থিক এবং সামাজিক বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে।

সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ক্ষতির শিকার হয়েছে পরিবহন ব্যবসায়ী ও কর্মী, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় শক্তি এবং পর্যটন খাত, খনিজ তেল খাত, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বার।

অর্থনীতিবিদরা ভাবছেন এই বৈশ্বিক মহামারি কীভাবে দুনিয়াকে বদলে দেবে। পুঁজিবাদ, সরকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং বিশ্বায়ন নিয়ে হয়তো আবার ভাবার সময় এসেছে।

অ্যাপলের সতর্কবার্তা

১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে ছুটির দিন ছিল এবং স্টক মার্কেট বন্ধ ছিল। কিন্তু ওইদিন অ্যাপল বিপদের ঘণ্টা শুনতে পায়। তারা সতর্ক করে দেয় বছরের প্রথম তিন মাসের রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা তারা অর্জন করতে পারবে না। কারণ চীনে তাদের আইফোনের উৎপাদন কমে গেছে, চীনে অ্যাপলের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে। মহামারি তাদের চাহিদা এবং যোগান দুই ধসিয়ে দিয়েছে।

২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, আকস্মিক, গভীর এবং ব্যাপক প্রভাবের ক্ষেত্রে গুরুতর মহামারি ঠিক বিশ্বযুদ্ধের মতো।

পরের মাসে অ্যাপল আবারও সতর্ক করে দিয়ে বলে, হাজারো কোম্পানি ভয়ানক চাপে আছে। বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন এবং যথাসময়ে মালামাল সরবরাহের উপর টিকে থাকা গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপ এবং আমেরিকায় তাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়েছে।

চীনের পর সারা বিশ্বেই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উড্ডয়ন সংস্থা কাপা জানিয়েছে, সরকারি সহায়তা ছাড়া মে মাসের মধ্যেই অধিকাংশ এয়ারলাইন্স দেউলিয়া হয়ে যাবে।

করনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য নীতির অধ্যাপক এসওয়ার প্রাসাদ বলেন, ‘পণ্য, পুঁজি ও মানুষের অবাধ প্রবাহ থেকে অনেক সুবিধা পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকট, মহামারি এবং ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রভাব বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার পথও তৈরি করেছে।’

কোম্পানি এবং রাষ্ট্রগুলো কীভাবে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে তা নিয়ে আলাপ আলোচনা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। অনেকে মনে করছেন ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে চিকিৎসা সরঞ্জামের মত ভীষণ প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলোর দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একজন সিনিয়র অ্যাডভাইজর উইলিয়াম রেইন্সচ বলেন, ‘মহামারি আমাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ যার মাধ্যমে গত ৫০ বছরে বৈশ্বিক বাণিজ্যের অগ্রগতি হয়েছে তা বাতিল করে দিতে পারে না। তবে প্রশ্ন হলো এগুলো কি আগের মতো একইভাবে এবং একই মাত্রায় ব্যবহার করা হবে কিনা।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাস আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যে সাপ্লাই চেইন আমরা যতটা মনে করি তার চেয়েও অনেক বেশি ভঙ্গুর এবং অপ্রত্যাশিত কারণে এটি আকস্মিকভাবে ব্যাহত হতে পারে।’

বাজার ভেঙে পড়ায় নীতিনির্ধারকদের প্রতিক্রিয়া

১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে আমেরিকার স্টক মার্কেট পড়েই যাচ্ছে। ইউরোপ এবং এশিয়ার মার্কেটও পড়তিতে। আমেরিকার দ্য ডো ৩৫ শতাংশ, হংকং এর হ্যাং সেং ১৮ শতাংশ এবং ইউরোপের স্টক প্রায় এক তৃতীয়াংশ পড়ে গিয়েছে।

ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ নীল শিয়ারিং জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্টক মার্কেটের পায়ের নিচের মাটি রাখার সামর্থ্য সীমিত। ইতিহাস বলে, ভাইরাস যখন সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায় ইকুইটি মার্কেট তখন সর্বনিম্ন সীমায় চলে যায়। স্টক মার্কেট আরো কিছুদিন চাপের মধ্যে থাকবে।

মার্কিন ফেডারেল ব্যাংক তাদের সুদের হার রেকর্ড পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডও মার্চে দুই দফায় সুদের হার কমিয়েছে।

এরপর কী হবে?

শুক্রবার (২০ মার্চ) গোল্ডম্যান স্যাকস সিএনএনের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছে, দ্বিতীয় ত্রৈমাসে মার্কিন জিডিপি বার্ষিক ২৪ শতাংশ হারে কমতে পারে এবং এই বছরের শেষে বেকারত্বের হার ৯ শতাংশ বেড়ে যাবে। আকার এবং গতিতে ঐতিহাসিকভাবে ছাঁটাই এবং ব্যয় সংকোচন ঘটবে।

গোল্ডম্যানের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০০৮ সালের মহামন্দার চেয়েও খারাপভাবে অর্থনৈতিক পতন ঘটবে। সে বছরের শেষ চতুর্থাংশে জিডিপির হার ৮ দশমিক ৪ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এবার ১৯৫৮ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ১০ শতাংশের রেকর্ডও ছাড়িয়ে যাবে।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ট্রাম্পের প্রশাসনে যোগ দিতে যাওয়া একজন অর্থনীতিবিদ এবং সিএনএনের সাবেক কন্ট্রিবিউটর কেভিন হ্যাসেট বলেন, ‘চলমান বৈশ্বিক মহামারি ১৯২৯ সালে সৃষ্টি হওয়া বিশ্বমন্দার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে যা এক বছর স্থায়ী হয়েছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘হয় আমাদের বিশ্বমন্দার সম্মুখীন হতে হবে, না হয় জনগণকে কাজে পাঠানোর নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে।’

Please Share This Post in Your Social Media

আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2020 Lightnewsbd

Developer Design Host BD