‘তিনবার বাড়ি ভাঙি নদীর কাছারোত পড়ি আছলোং। এলা তাও ভাঙি যাবার নাগছে। জমি নাই, ভিটা নাই। হামার যাবার কোন জাগা নাই বাহে’। ধরলার ভাঙনে সবকিছু হারানো ৭৫ বছরের জোসনা বালা এ কথা বলেই কাঁদতে লাগলেন। বলেন, কয়দিন থাকি রাইতোত নিন্দ পারব্যার পাইনা। কোম্বালা কাছার ভাঙি নদী পড়ি-এই ভয়ে চোখোত নিন্দ নাই।
জোসনা বালা কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার জয়কুমর কামার পাড়ার বাসিন্দা। বয়স্ক, বিধবা, ভিজিডি জাতীয় কোন ভাতা না পাওয়া এই হতদরিদ্র বৃদ্ধা সারাদিন নদীর পারে বসে বসে কাঁদছেন। আর মাঝেমধ্যে মাতম আর বিলাপ করছেন। জোসনা বালার পাড়ার ঘরে ঘরে ভাঙন আতঙ্ক। ধরলা প্রবল স্রোতে আঘাত হানছে দিনে-রাতে। ঘর-বাড়ি সরানোর পাশাপাশি গাছপালা, বাঁশঝাড় কাটার হিড়িক পড়েছে। তাও সব রক্ষা করা যাচ্ছে না।
এই গ্রামের দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলম জানান, সহায় সম্বল বলতে শ্বশুরের কাছ থেকে পাওয়া পাঁচ শতক বাড়িভিটা ছিলো। কয়েকটি ফলবতি গাছও ছিলো। বাঁশঝাড় ছিলো ছোট একটা। কিন্ত ধরলার তাণ্ডবে সব শেষ। নদীর পার আর স্রোতে ঘূর্ণাবর্ত দেখিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, এমন ভাঙনোত কী টেকা যায় ভাইজান। প্রতিবেশী মৃণাল চন্দ্র জানান, তার বাড়ি ভিটা ছিলো ২৫ শতক। সুপারি বাগান, বাঁশঝাড়, ফলের গাছ মিলে বেশ ভালোই চলছিলো। কিন্তু ধরলার প্রবল ভাঙনে ভিটা হারিয়ে এখন কোথায় আশ্রয় নিবেন সেই চিন্তায় অস্থির। তিনি বলেন, ইউএনও সাইব দেখি গেইছে। কিছু রিলিফ দিবার চাইছে। হামরা রিলিফ চাই না। নদীটা বান্দি চাই।
শনিবার সরেজমিন কামারপাড়া গিয়ে দেখা গেছে, অনেকেই আধাপাকা আর পাকা বাড়ি ভেঙে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। এই গ্রামের জিয়াউল হক জানান, ভাঙনরোধে কোন ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষণ নেই। এ অবস্থায় বাড়ি না সরিয়ে উপায় নেই। ঘর সরিয়ে নিতে ব্যস্ত বাদশা আলম, সেকেন্দার, নুর জামাল, আমিনুরসহ অনেকেই। তারা জানান, বর্ষা শুরুর আগে থেকে ভাঙন শুরু হয়েছে । এ পর্যন্ত ২০টি পরিবার ভিটে হারিয়েছে। হুমকিতে রয়েছে আরো অর্ধশত পরিবার ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
ভাঙন কবলিতরা অভিযোগ করেন ঊর্বর ফসলি জমি, সুপারি ও ফলের বাগান সমৃদ্ধ গ্রামটি দেখতে দেখতে বিলীন হয়ে গেলেও ভাঙন রোধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। গ্রামের বাসিন্দা হাফেজ আলী বলেন, এমপি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ডিসি কতজনের কাছে আবেদন করলোং, কাইয়ো ব্যবস্থা নিলে না। গৃহস্থ মানুষ থাকি এলা হামরা পথের ফকির হয়া যাবার নাগছি।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, জেলার ১৭টি পয়েন্টে নদী ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে ৩টি পয়েন্টে তীর প্রতিরক্ষার কাজ চলছে। বাকীগুলোর কোথাও কোথাও বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। তবে জয়কুমরসহ কয়েকটি এলাকায় অস্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কোন অনুমোদন না পাওয়াও কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।
লাইট নিউজ