স্টাফ রিপোর্টার : সৌদি আরব থেকে ছয় বছর পর দেশে ফিরবেন নওগাঁর মো. মফিদুর রহমান। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের টিকিট পেতে তাঁকে রিয়াদে বেশ কয়েক দিন ঘুরতে হয়েছে। কারণ টিকিট নেই। শেষে টিকিটের সুরাহা হলেও ভাড়া শুনে আঁতকে উঠলেন। আসা-যাওয়ার জন্য তাঁকে গুনতে হবে প্রায় দেড় লাখ টাকা। করোনার আগে এই ভাড়া ছিল ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা।
কষ্টেসৃষ্টে জাতীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমানের টিকিট কিনলেন মফিদুর রহমান। কিন্তু বিজি ৪০৪০ ফ্লাইটে উঠে দেখলেন, বিমানের অর্ধেকের বেশি আসন খালি।
গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ ফটকে কথা হয় প্রবাসী মফিদুর রহমান সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘বিদেশি এয়ারলাইনসের ভাড়া গলাকাটা। ভাবছিলাম বিমানে ভাড়া কিছুটা কম হবে। কিন্তু রিয়াদে দেখাচ্ছে বিমানের আসন খালি নেই। তাই ভাড়া বেশি। ফ্লাইটে উঠে দেখি শতাধিক আসন খালি।’
মফিদুর রহমানের এই অভিযোগের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে। তাতে দেখা যায়, ওই দিন বিজি ৪০৪০ ফ্লাইটে ৩২০ আসনের বিপরীতে রিয়াদ থেকে যাত্রী ছিল ২১৪ জন। অর্থাৎ ১০৬ আসন খালি এসেছে। এর মধ্যে ২০৮ জন যাত্রী ছিল ইকোনমি ক্লাসে এবং ছয়জন ছিল বিজনেস ক্লাসে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যাওয়ার সময় যাত্রীর চাপ বেশি থাকে। আসার সময় আসন পূর্ণ হওয়ার মতো যাত্রী থাকে না।
এই দাবির যৌক্তিকতা খুঁজতে একই দিনের টার্কিশ এয়ারলাইনসে খবর নিয়ে দেখা যায়, তাদের ফ্লাইটে রিয়াদ থেকে কোনো আসন খালি আসেনি। বিমান সংস্থাটির বাংলাদেশ কার্যালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওই দিনের টার্কিশ এয়ারলাইনসের টিকে-৭২২ এবং টিকে-৭১২ ফ্লাইটের ২৩২ আসনই যাত্রীপূর্ণ হয়ে এসেছিল।
টিকিট ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত যেসব আসনের ভাড়া কম, সেগুলো দ্রুত বিক্রি হতে থাকলে ভাড়া আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। মানে টিকিটের চাহিদা বেশি, তাই ভাড়া বেশি। কিন্তু আসন খালি থাকার পরও ভাড়া কিভাবে বেশি দেখায়, জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এয়ারলাইনস আগে থেকেই বিভিন্ন ফ্লাইটের বেশ কিছু টিকিট কিনে রাখে। এটা এক ধরনের ‘কারসাজি’। গ্রুপ টিকিটের আড়ালে এই টিকিট সস্তায় কিনে আসন ব্লক করে রাখা হয়। পরে তারা বিভিন্ন ব্যক্তিকে একটি গ্রুপে দেখিয়ে বেশি দামে সেই টিকিট ইস্যু করে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি মনছুর আহামেদ কালাম বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিমানভাড়া তিন গুণের বেশি বেড়েছে। আগে যে ভাড়া ২৫ হাজার টাকা ছিল, তা বেড়ে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা টাকা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যাত্রী পরিবহনে দৈনিক দরকার সাড়ে পাঁচ হাজার আসন। এর বিপরীতে এখন সব এয়ারলাইনস মিলে আসন আছে সাড়ে তিন হাজার। চাহিদা ও জোগানের সংকট কাজে লাগানোর অনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে এখন। এর দায় অবশ্যই এয়ারলাইনসগুলোকে নিতে হবে। কারণ তারা সিন্ডিকেশন করে টিকিট ব্লক করে রাখছে। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এর সঙ্গে যদি কোনো ট্রাভেল এজেন্টের সংশ্লিষ্টতা থাকে তাহলে তারা তা প্রকাশ করুক।’
হঠাৎ আসনসংকট দেখা দিল কেন, জানতে চাইলে আটাব সভাপতি বলেন, ‘সৌদি আরব ও ইউএই ভিসা দেওয়া বাড়িয়েছে। ওমানসহ আরো কয়েকটি দেশে ভিজিট ভিসা দেওয়া হচ্ছে। অনেকে করোনার নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশে ফিরতে পারেনি, এখন করোনা কমায় তারা ফিরছে। অনেক প্রবাসী কর্মস্থলে ফিরতে চায়। টিকিট না পেয়ে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারা বাড়তি দামে টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছে।’
আটাব সভাপতি বলেন, ‘আসনসংখ্যা বাড়াতে আমরা বিমানসহ অন্যান্য এয়ারলাইনসকে বাড়তি ফ্লাইট দিতে বলেছি। আমরা সংবাদ সম্মেলন করেছি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আমরা সমাধান চেয়ে চিঠি দিয়েছি। এখনো আশার আলো দেখছি না।’
মধ্যপ্রাচ্যর যাত্রীদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বহন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। বিদেশি এয়ারলাইনসের ভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে সরকারের প্রভাব থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া এ সময়ে কেন অন্তত মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নাগালের মধ্যে রাখা হয়নি, সে প্রশ্ন তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
আটাব জানিয়েছে, ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্ক ২৩ ঘণ্টার ভ্রমণে ভাড়া লাগছে মাত্র ৬৫ হাজার টাকা। অথচ মধ্যপ্রাচ্যে ছয় ঘণ্টার ভ্রমণে নেওয়া হচ্ছে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। আগে যে টিকিটের মূল্য ছিল ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার, সেই টিকিট এখন লাখ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। আগে দুবাইয়ের ভাড়া ছিল ৪০ হাজার, বর্তমানে দুবাই যেতে লাগছে এক লাখের ওপরে। ওমানের মাসকাটে আগে একমুখী ভাড়া ছিল ৩৫ হাজার, বর্তমানে সব এয়ারলাইনস ৭২ হাজার টাকা নিচ্ছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক সভাপতি আবুল বাশার এর জন্য দুষছেন বিমান কর্তৃপক্ষকে। তিনি বলেন, দেশীয় এই বিমান সংস্থা নিজেদের লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন খাতে অপ্রয়োজনীয় মূল্য বৃদ্ধি করে। বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো বিমানকে অনুসরণ করে পাল্লা দিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সুযোগে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো বাংলাদেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে নিষ্পেষিত হচ্ছেন প্রবাসগামী নিরীহ কর্মীরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট পরিচালনাকারী এয়ারলাইনগুলো ন্যূনতম ভাড়া (লোয়ার আরবিডি) বাড়িয়ে দিয়ে সব ধরনের আসনে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। বেশির ভাগ এয়ারলাইস ‘লোয়ার আরবিডি’ শো করছে না।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মধ্যপ্রচ্যে ফ্লাইট পরিচালনাকারী ‘বাজেট এয়ারলাইন’ ফ্লাই দুবাই, এয়ার অ্যারাবিয়ার দুবাইয়ে ওয়ান ওয়ের জন্য ভাড়া পড়ছে এক লাখ ১০ হাজার টাকা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়াও এক লাখ টাকার ওপরে, তবু আসন পাওয়া যাচ্ছে না। এসব এয়ারলাইনসের রিটার্নসহ ভাড়া এক লাখ ৩০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা।
আগামী ১০ জানুয়ারি ঢাকা থেকে দুবাইয়ে ওয়ান ওয়ের সৌদি এয়ারলাইনসের ভাড়া এক লাখ ৩১ হাজার টাকা, জাজিরা এয়ারলাইনসের ভাড়া ৮৫ হাজার টাকা। এই গন্তব্যে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসের ৯৩ হাজার, এমিরেটস ও ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ৯৮ হাজার ৮০০ টাকা।
সূত্র : কালের কণ্ঠ