আবহওয়া অধিদপ্তরের পূর্বের ঘোষণায় জেনেছিলাম ১৮ থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তীব্র শৈত্য প্রবাহ থাকবে। তা সত্বেও দীর্ঘ দিন পর সরকারি ছুটির সাথে মিলিয়ে চলে গেছি নিজ গ্রামে। গাইবান্ধ জেলার সাদুল্লাপুরের নলডাঙ্গা ইউনিয়নে।
ব্যক্তিগত কাজ শেষ করে আমি আর আনোয়ারুল আজীম ভাই (গাইবান্ধা-৩ আসনের সাদুল্লাপুর উপজেলার সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি) আমার খামারে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। প্রচন্ড শীতে এক পর্যায়ে সকলেই যবুথবু অবস্থা প্রায়। ঘড়ির কাটায় তখন পৌনে ৮টা। আজীম ভাই বললেন, ‘একটা মিটিং আছে চলো স্বচোখে দেখে আসো সংসদ সদস্যের কাজের অগ্রগতি কেমন? আমরা কি কি কাজ করছি?’ কোনো কিছু না ভেবেই রাজী হয়ে গেলাম। কারণ শীত তো থাকবেই, তাই বলে কি ঘরের কোনো বসে থাকবো না কি?
যাত্রা শুরু করি। গন্তব্য স্থান ২ নং নলডাঙ্গা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড ‘নামাপাড়া’। পথিমধ্যে ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহরিয়ার রাসেল, যুবলীগ নেতা শরীফ ভাই, সাংবাদিক শাহিন, আওয়ামী লীগ নেতা শাহীন চোকদার এক দোকানে চা-এর নিমন্ত্রণ করলেন। আজীম ভাইও এক মত। চা খেয়েই রওনা দিই। আমিও রাজী। আমাদের সাথে থাকা মিজান ভাই বিদায় নিলেন। আবারও গন্তব্যের দিকে চলা শুরু হলো। আমি আর আজিম ভাই আমার গাড়িতে উঠবো এমন সময় যুবলীগ নেতা রাসেল চাচা বললেন, ‘ওখানে গাড়ি যাবে না। দেড় কিলোমিটার দূরে গাড়ি রেখে হেঁটে যেতে হবে। গাড়ি নিও না। মোটরসাইকেলে ওঠ।’ কিন্তু মোবাইলের ওয়েদার ক্যালকুলেটারে তাকিয়ে দেখি তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সুতরাং গাড়ি নিতেই হবে। পথিমধ্যে আজিম ভাই আমার স্কুল জীবনের বন্ধু নামাপাড়া বাসিন্দা এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নলডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ শাখার সাবেক সভাপতি ফারুক মিয়াকে ফোন করলেন। ও নিজেই ওই অনুষ্ঠানে আয়োজক। ও জানালো গাড়ি মিটিং স্থল পর্যন্ত যাবে কোনো সমস্যা নেই। তাই আমারও নিশ্চিন্ত।
মাত্র ৩ মিনিট পর দশলিয়া মৌজার শেষ প্রান্তে এসে থমকে গেলাম। আমার চালক বললেন, ‘স্যার কোনো ভাবেই গাড়ি সামনে নেয়া যাবে না। জায়গা একদম সরু। দুই পাশেই পুকুর। পাড়গুলো ভাঙ্গা, দুর্বল। শত ভাগ নিশ্চিত দুর্ঘটনা ঘটবে। কি করবো?’ চালকের কথা শুনে গাড়ি থেকে নেমে আরোও ভয়াবহ অবস্থা দেখলাম। একটু সহস দেখিয়ে সামনে এলেই বিপদে পড়তাম। কুয়াশা আর অন্ধকারে মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে দেখলাম। দেখতেই আজীম ভাই বললেন, ‘আপা(সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি) যে টাকা দিয়েছেন তাতে এই রাস্তায় ভালো ভাবে মেরামত হবে না। আরো বেশি বরাদ্দ দিলে ভালো হতো।’
শরীফ ভাই আমি আর আজীম ভাই হাটছি আর কথা বলছি। বেশ কয়েক মিনিট হাটার পর বন্ধু ফারুক মোটরসাইকেল নিয়ে এলো। এলো একটি অটো। রাস্তায় বেশ খানিকটা সময় নষ্ট হলো। রাত দশটায় এসে পৌছলাম গন্তব্য স্থান মিলন মিয়ার বাড়ির উঠানে। কনকনে শীতে আমাদের প্রত্যেকের শরীর শির শির করছে। কান বন্ধ হয়ে আসছে। থেকে থেকে শরীর কাপছে। তবে সব চেয়ে বড় অবাক করার বিষয় হলো, ওই উঠানে তখনও উপস্থিত ছিল প্রায় ১০০ এরও বেশি মানুষ। যাদের বেশির ভাগই বয়োবৃদ্ধ। তাপমাত্রা তখন ১১ ডিগ্রী। এখানে এসে বুঝতে পারলাম বন্ধু ফারুক অনেকটা ইচ্চা কৃতভাবেই আমাদের গাড়িসহ ডেকে ছিল। যেন আমাদের সাময়ীক কষ্ট এই এলাকার মানুষের সারা জীবনের কষ্টের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মিটিং শুরু হলো। উপস্থাপনা করছিলেন, আমার শ্রদ্ধয়েও শিক্ষক জাহিদুল ইসলাম। মিটিং এর সভাপতি ছিলেন আরেক শিক্ষক কোরবান আলী। ইতিমধ্যে মিটিং স্থলে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরাও উপস্থিত হয়েছেন। আলোচনার সারসংক্ষেপ থেকে বুঝতে পেলাম এই ওয়ার্ডের প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা সংস্কারের জন্য সংসদস্য সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি একটি টিআর বরাদ্দ দিয়েছেন। কিন্তু ওই সড়কের দু পাশ জুড়েই রয়েছে অসংখ্য পুকুর। এই পুকুর পাড়গুলো যেন মালিকরা নিজের খরচে বেঁধে নেন সে জন্যই এই মিটিং।
মিটিং শুরু হলো। যতই সময় গড়াতে শুরু করলো ততই তাপমাত্রা কমছিল। কিন্তু লোকসমাগম বাড়ছিল। আমিও ততই অবাক হচ্ছিলাম। বক্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী বিজয়ের এই ৪৯ বছরেও এই এলাকায় কখনও কোনো কোনো জনপ্রতিনিধির নেক নজর পড়েনি। কোনো সংসদ সদস্য এখানে আসেনি। আর যারা সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি ছিলেন তারা শুধু নিজের আখের গুছিয়েছেন। এখানে কোনো কাজই করেননি। এই ওয়ার্ডের মোট ভোটার ৩৩’শ। যা পুরো ২নং নলডাঙ্গা ইউনিয়নে সর্বোচ্চ। সংখ্যা গড়িষ্ঠতার দিক থেকে এখানে আওয়ামী ঘরানার সমর্থন বেশি। কিন্তু তারপরও এই এলাকার মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। একটু বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় ফসলী জমি। ভেসে যায় মাছের ঘের। ডুবে যায় রাস্তা-ঘাট। পুরো ইউনিয়নের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ। এক জন গুরুতর অসুস্থ্য মানুষকে অ্যাম্বুলেন্স তো দুরের কথা, ভ্যানে করেও হাসপাতালে নেয়ার অবস্থা থাকে না।
মিটিং চলছে। তাপমাত্রা ক্রমেই কমছে। তখন ঠিক রাত ১১টা ১৫ মিনিট। সামনে উপস্থিত মানুষগুলোকে দেখে ভাবতে লাগলাম, এই রাস্তাটার গুরুত্বই এতই বেশি যে দাবী আদায়ের কথা বলতে শীতকে উপেক্ষা করে এত রাতেও তারা এখানে দাড়িয়ে আছেন। মনে মনে ভাবলাম বিজয়ের এই ৪৯ তম বছরে মাত্র দেড় কিলোমিটার সড়ক সংস্কারের জন্য ১১ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাত সাড়ে ১১ টায় এভাবে দাড়িয়ে থাকার নজির মনে হয় এটাই প্রথম। ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহরিয়ার রাসেল বললেন, এই এলাকার মানুষের দুর্ভোগ দুর করার জন্য এখানে কেউ আসেনি। শুধু ভোরে সময় প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন। কিন্তু বিজয়ী হওয়ার পর আর কোনো খোঁজ খবরও কেউ রাখেনি। এখানকার মানুষকে ঠকিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা কল্যান কাকা অনেক চেষ্টা করেছেন। সবার দ্বাড়ে দ্বাড়ে ঘুরেছেন। কিন্তু কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেননি।
অনুষ্ঠান শেষ। রাত পৌনে ১২টা। আজিম ভাই বললেন, আমাদের এলাকার সবচেয়ে অবহেলিত এলাকা এটি। এখনও পর্যন্ত যারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তারা কেউ আর পরবর্তিতে খোঁজ নেননি। নলডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ফারুক আমাকে একাধিক বার বলার পর রোস্তাটা দেখে খুবই খারাপ লেগেছে। স্মৃতি আপা (সংসদ সদস্য) কে বলার সাথে সাথে তিনি এক মুহূর্ত দেরি করেননি। সব কথা শোনার পর তিনি বলেন, এখন যা আছে তাই দিচ্ছি। সবগুলো রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু করো। বেঁচে থাকলে সবগুলো কোড নম্বর করে এগুলো পাকা করার ব্যবস্থা করবো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিশন বাস্তবায়ন করতে হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। এলাকার উন্নয়নে যদি আমাদের মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুড়তে হয় আমি তাই করবো। আমার সংসদীয় আসনের কোনো এলাকা যেন বঞ্চিত না থাকে।
অনেক রাতে বাসায় ফিরে ভাবতে লাগলাম, এই এলাকার সড়কের যে দৃশ্য দেখলাম তাতে মনে হলো এটা এই ভূ-খণ্ডের বাহিরের কোনো স্থান। যেখানে উন্নয়নের কোনো ছোয়া নেই। গত ২০ বছরেও এখানে কেউ সড়ক সংস্কারের জন্য একটি টাকাও বরাদ্দ দেয়নি। এমন কি সড়ক সংস্কারের অভাবে ক্ষ হতে হতে নিচু হয়ে গেছে। কিন্তু এখানকার মানুষ এসব কষ্টের কথা বলার জন্য কোনো প্রতিনিধি পাননি। ২০ বছরেও যাদের কেউ খোঁজ নেয়নি তাদের খোঁজ নিয়েছেন এমপি স্মৃতি।
লেখক
ইমরুল কাওসার ইমন
সাংগঠনিক সম্পাদক
রংপুর বিভাগ সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা