গত সরকারের আমলে অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানে বড় ধরনের কারসাজি হয়েছে। পরিসংখ্যানের ব্যাপক রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারো (বিবিএস) সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে উন্নয়ন দেখাতে পরিসংখ্যানকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে।
আ হ ম মুস্তফা কামাল পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় যা বেশি মাত্রায় ঘটেছে। সরকার যেভাবে চেয়েছে, সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে পরিসংখ্যান। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জানতে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি পরিসংখ্যান জালিয়াতির প্রচুর আলামত পেয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য সমকালকে বলেন, বিবিএস কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে। জিডিপি, মূল্যস্ফীতি ও মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যানে গোঁজামিল পেয়েছেন তারা। কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, সরকারের নির্দেশে অনেক ক্ষেত্রে মনগড়া তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে বিবিএস। মাথাপিছু আয়, জিডিপি এবং মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন তৈরি হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন না নেওয়া পর্যন্ত প্রকাশ করা হতো না। প্রধানমন্ত্রী বিদেশে থাকলে প্রতিবেদন প্রকাশে লম্বা সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার নজির আছে।
বিবিএসের বিভিন্ন উইংয়ের একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সব সরকারের সময়ই বিবিএসের পরিসংখ্যানে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন থাকত। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে এ প্রবণতা বেড়ে যায়। এ কারণে উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পূর্বাভাসের সঙ্গে বিবিএসের পরিসংখ্যানে অনেক পার্থক্য থাকত। বিবিএস পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিসংখ্যান বিভ্রাট প্রকট হয়।
সারাবছরই কোনো না কোনো ধরনের জরিপ এবং গবেষণা করে থাকে বিবিএস। এর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির হিসাব, মূল্যস্ফীতি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাব সবচেয়ে মৌলিক এবং স্পর্শকাতর। শুমারিসহ বিবিএসের মোট ৮টি উইং আছে। এর মধ্যে ছয়টি উইংয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল।
প্রায় সব কর্মকর্তা একই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তারা বলেন, শেখ হাসিনার আমলে বিবিএস প্রথমে মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান প্রস্তুত করে পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে জমা দিত। পরিকল্পনামন্ত্রী নিজের ইচ্ছামতো বাড়িয়ে-কমিয়ে নিয়ে আসার নির্দেশ দিতেন। তাঁর পছন্দমতো পরিসংখ্যান সাজিয়ে পাঠালে তা অনুমোদন করতেন মন্ত্রী। পরে তা অনুমোদনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হতো। সেখান থেকেও অনেক সময় পরিবর্তন করার নির্দেশ আসত। অনেক পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার মিল ছিল না। এ কারণে বিবিএসের পরিসংখ্যান অনেকে বিশ্বাস করতেন না। তবে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান ব্যবহার করতে হতো। এমনকি বিশ্বব্যাংক, এডিবি বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন প্রাক্কলন দিলেও অর্থবছর শেষে বিবিএসের পরিসংখ্যানই আমলে নিতে হতো।
জিডিপির হিসাব প্রাক্কলনের সঙ্গে সম্পর্কিত এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বিবিএস পর্যন্ত আসার আগেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ থেকে যে তথ্যউপাত্ত দেওয়া হতো তা সঠিক থাকত না। যে কোনো পরিসংখ্যান প্রস্তুতের ক্ষেত্রে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ উপাত্ত মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে সংগ্রহ করে বিবিএস। যেমন, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এবং রাজস্ব আয়ের তথ্য এনবিআর থেকে সংগ্রহ করা হয়। একইভাবে পণ্য রপ্তানির তথ্য রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ কারণে পরিসংখ্যান জালিয়াতির জন্য কেবল বিবিএসকে দায়ী করাটা ঠিক হবে না।
সম্প্রতি এক ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বিবিএস গবেষণায় যে উপাত্ত পাবে সেই পরিসংখ্যানই প্রকাশ করবে। বিবিএসের কোনো প্রতিবেদনই তাঁর কাছে পাঠানো কিংবা অনুমোদন নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এতে পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা ফিরেছে।
মাথাপিছু প্রকৃত আয় কমতে পারে ৫০০ ডলার
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির অপর একজন সদস্য বলেন, গত অর্থবছর সরকার মাথাপিছু যে আয় দেখিয়েছে প্রকৃত আয় তার থেকে কমপক্ষে ৫০০ ডলার কম হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় হবে ২ হাজার ২০০ ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাময়িক হিসাবে যা ২ হাজার ৭৮৪ ডলার দেখানো হয়েছিল। তিনি বলেন, জিডিপির আকার ও প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানোর কারণে মাথাপিছু আয়ও বেড়ে যায়। এ ছাড়া জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানোর কারণেও মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়।
বিবিএসের সর্বশেষ জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। অনুমিত জনসংখ্যা থেকে প্রকাশিত এ জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ কম। দুই বছর আগের বিবিএসের নিজস্ব এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১ হাজার। বিবিএসের জনমিতির হিসাবে দেশে প্রতি ১০ বছরে মানুষ বাড়ে ২ কোটির মতো। অর্থাৎ প্রতি বছর মানুষ বাড়ে ২০ লাখ। এ হিসাবে গত দুই বছরে আরও ৪০ লাখ জনসংখ্যা জনমিতিতে যুক্ত হওয়ার কথা। দুই হিসাব মিলে দেশে জনসংখ্যা হওয়ার কথা ১৭ কোটি ৩১ লাখ ১ হাজার জন।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, অতিমারি করোনাকাল ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের চেয়ে অর্ধেকরও কম হয়ে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নামে। তখনও মাথাপিছু আয় ১০০ ডলার বেশি হয়েছে বলে দেখানো হয়। মোট ২ হাজার ৩২৬ ডলার মাথাপিছু আয়ের তথ্য প্রকাশ করে বিবিএস। অথচ করোনার সংক্রমণকালে তিন মাসের মতো শিল্পকারখানা বন্ধ ছিল। দফায় দফায় লকডাউনে ব্যবসা-বাণিজ্য কর্মসংস্থান প্রায় স্থবির ছিল। এ সময় অর্থনীতির কোনো সূচকই ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। সারাবিশ্বে তাই হয়েছে। পরের অর্থবছরেও একই কাণ্ড ঘটে। ২০২০-২১ অর্থবছর প্রবদ্ধি দেখানো হয় ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বাড়ে ২৬৫ ডলার। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘোষণা করা হয় ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদনেও একই কাণ্ড দেখা গেছে। মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি হলে সরকারের অনুমোদন পাওয়া যেত না। ফলে বিবিএসের প্রকাশিত মূল্যস্ফীতির হার যে বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না, তা বহুদিন ধরে তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরে বলে আসছিল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের হিসাবে, প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার সরকার প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে বেশি। শেখ হাসিনা সরকার সর্বশেষ গত জুন মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে গেছে। তাতে ওই মাসের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি প্রকাশ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে এটি কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। বিবিএস সূত্র জানায়, আগামী সপ্তাহে অক্টোবরের মূল্যস্ফীতি প্রকাশ করা হবে।
আগামীতে পরিসংখ্যান জালিয়াতি বন্ধে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি সম্প্রতি এক ব্রিফিংয়ে বলেছে, বিবিএসকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশ করা হবে। বিবিএসের কোনো তথ্য প্রকাশ করতে যাতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা পরিকল্পনামন্ত্রী কিংবা অন্য কোনো সংস্থার অনুমোদন নিতে না হয়, সেজন্য এ সুপারিশ করবে কমিটি। এ ছাড়া, প্রয়োজনীয় জনবলসহ নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে বিবিএসের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি সংশোধনের সুপারিশ করা হবে।