আর্মেনিয়ার অবৈধভাবে দখল করে রাখা নাগরনো-কারাবাখ এবং এর পার্শ্ববর্তী সাতটি থানা দখলদার মুক্ত আজারবাইজানী সেনাবাহিনী তাদের সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা স্বাধীন করছে।
দিন যতই যাচ্ছে এই যুদ্ধে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের ভূমিকা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তুরস্ক, পাকিস্তান, ফ্রান্সসহ অনেক দেশ তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। কিন্তু এ অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ইরান এখন তার অবস্থান পরিষ্কার করেনি।
আজারবাইজানের পক্ষে বা আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে কোনও বক্তব্য তেহরান থেকে আসেনি। অথচ স্বাভাবিক ভাবে সকলের প্রত্যাশা ছিল ইরান তুরস্কের মত আজারবাইজানের পক্ষ না নিলেও অন্তত আর্মেনিয়ার অবৈধ দখলদারিত্ব আর নিরীহ মানুষ হত্যাকে নিন্দা করবে। কিন্তু তাও করেনি। এমনকি ইরানি মিডিয়াও আজারবাইজানের পক্ষে আওয়াজ তুলছে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে ইরান কি তাহলে আর্মেনিয়ার পক্ষে? যদি তাই হয় তবে কেন?
ইরানের পরে আজারবাইজানই একমাত্র দেশ যার জনসংখ্যার শতকরা হারে সবচেয়ে বেশি লোক শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী। দেশটির ১ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ ভাগেরও বেশি মানুষ শিয়া। এদিক থেকে চিন্তা করলে ইরানের স্বাভাবিক ভাবেইআজারবাইজানের পক্ষ নেওয়া উচিত বলে মনে হবে। তাছাড়াও যে ইরান তার অথাকথিত শিয়া মতাদর্শ প্রচারের জন্য মধ্য প্রাচ্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে সে কেন এই ক্রান্তিকালে আজারবাইজানের পাশে দাঁড়াবে না? শুধুমাত্র যদি ধর্মীয় দিক থেকেও চিন্তা করা হয় তাহলেও প্রশ্ন জাগে যে ইরান ইসলামী প্রজাতন্ত্র নামের দেশটি মুসলিম অধ্যুষিত আজারবাইজানকে রেখে কেন কট্টর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আর্মেনিয়ার পক্ষে?
আর এটা ঘটলো এমন একটি যুদ্ধে যাকে আর্মেনিয়া “পবিত্র ভূমি” রক্ষার লড়াই বলে ঘোষণা দিয়েছে। খ্রিস্টান একটি রাষ্ট্রের “পবিত্র” এই লড়াইয়ে “ইসলামী প্রজাতন্ত্রের” সমর্থন! কেমন একটা খটকার বিষয় না? ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তার করার জন্য হাতে যতগুলো ট্রাম্পকার্ড ছিল সবই ব্যাবহার করেছে। কখনও ইসলামের বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে, কখনো শিয়া মতাদর্শের উত্থান দেখিয়ে, আর কখনোবা ইসরাইল-আমেরিকার বিরুদ্ধে ফাঁকা বুলি আওরিয়ে। কিন্তু ইরানের নগ্ন বিলাস ফুটে উঠেছে সিরিয়া এবং ইয়েমেনের যুদ্ধে।
আর এখন আজারবাইজানে ইরান দেখিয়েছে তার রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী জনপদে গণহত্যাকেও সে নীরবে সমর্থন দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এবার আসি কেন- এর উত্তরে। ইরান এই যুদ্ধে আজারবাইজানকে সমর্থন না দেওয়ার পিছেন আছে মূলত অভ্যান্তরিন এবং আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক এবং কৌশলগত হিসাব নিকাশ।
ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি ১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে আজারবাইজানের স্বাধীনতার ঘোষণার দেড় মাসের মধ্যেই তখনকার ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আকবর ভিলায়েতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকু সফর করে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সই করেন।
চুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সামরিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং আজারবাইজানকে ওআইসির সদস্যপদ পেতে আন্তর্জাতিক সহয়তা দেওয়া। ভিলায়েতি দেশে ফিরে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই ৪ জানুয়ারী ১৯৯২ তারিখে ইরান আজারবাইজানকে স্বীকৃতি দেয়। ইরানের তখন ইচ্ছা ও ধারণা ছিল আজারবাইজান নিকট ভবিষ্যতে ইরান ধাঁচের একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কিন্তু নতুন এই রাষ্ট্রটি গঠনের প্রথম সরকার মাত্র কয়েক মাস ক্ষমতায় ছিল। ওই বছরই জুন মাসের নির্বাচনে জয়ী হন প্যান-তুর্কী এবং প্যান-আজেরি হিসেবে পরিচিত আব্দুলফায এলচিবেই।
নতুন এই প্রেসিডেন্ট তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার প্রতি জোর দেন। তিনি বৃহত্তর আজারবাইজান গঠনেরও ঘোষণা দেন। বৃহত্তর আজারবাইজান বলতে বর্তমানের স্বাধীন আজারবাইজান রাষ্ট্র এবং ইরানের উত্তরাঞ্চলের আজেরি-তুর্কী জনগোষ্ঠী আধ্যুসিত ইরানী-আজারবাইজান নামে পরিচিত অঞ্চলকে বুঝায়।
১৮২৮ সালে তুর্কমেন চাই নামক চুক্তির মাধ্যমে আজারবাইজানের এই অংশটিকে ইরানের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়। আব্দুলফায এলচিবেই-এর ঘোষণা তখন ইরান সরকারকে বিচলিত করে। আজারবাইজান শক্তিশালী হলে ইরানের এই উত্তরপূর্বাঞ্চলটিতে বসবাসরত প্রায় দেড় কোটি আজেরি-তুর্কিরা স্বাধীনতা চাইতে পারে অথবা আজারবাইজানের সাথে একীভূত হতে পারে। সুতরাং শক্তিশালী এক আজারবাইজান ইরানের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই তেহরান কখনই বাকুকে শক্তিশালী দেখতে চায়নি।
আর আজারবাইজানকে দুর্বল রাখতে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চলের অশান্তি বিরাজমান রাখা। একারনেই ১৯৯২ সালে শুরু হয়ে ১৯৯৪ সালে এসে ভঙ্গুর শান্তি চুক্তি করা পর্যন্ত চলা আর্মেনীয় দখলদারি হামলার সময় ইরান আর্মেনিয়ার পক্ষ নিয়েছিল আজারবাইজানকে একহাত দেখিয়ে দিতে। এর পরে কখনও প্রত্যক্ষ কখনও বা পরখভাবে ইরানা আর্মেনিয়াকে সাপোর্ট দিয়েই গেছে।
সেক্যুলার মতাদর্শ বনাম শিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দ্বন্দ্ব আজারবাইজানের শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ মুসলমান। এদের ৮৫ ভাগ শিয়া এবং ১৫ ভাগ সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু আজারবাইজান রাষ্ট্রীয় ভাবে তুরস্কের মত সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী।
আজারবাইজান ছাড়া কোনও শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশই সেক্যুলার না। এরকম শিয়া জনগোষ্ঠীর সেক্যুলার একটি দেশ যদি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হয় তবে তা ইরানি মোল্লাদের শাসনের সিংহাসন নড়বড়ে করে দিতে পারে। ধর্মভিত্তিক শিয়া রাষ্ট্রের ধারনায় ঘুণ ধরাতে পারে।এ কারণেও ইরান শক্তিশালী আজারবাইজানের পথে কাটা হয়ে দাঁড়াবে। ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ইরানের উত্তরপুরবাঞ্চলীয় আজারবাইজান নামক এলাকাটিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে বিক্ষোভ হয়েছে। ওখানকার আজেরি-তুর্কী জাতি পারসিকদের পরেই ইরানের বৃহত্তম জাতিগত গোষ্ঠী এবং মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশেরও বেশি।
ইরান সরকার কখনই এই গোষ্ঠীটিকে মাথাচড়া উঠতে দেয়নি। তাই যখনই ওই এলাকায় বিক্ষোভ হয় ইরান তা শক্ত হাতে দমন করে। এবারও ওই এলাকাতে এবং আরও কিছু এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তুর্কিরা ইরান সরকারের আজারবাইজান-বিরোধী আবস্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। কিন্তু তেহরান সরকার তাদের কাছে মাথা নত করার নয়। রাশিয়া ফ্যাক্টর মধ্যপ্রাচ্যে ইরান রাশিয়া একে অপরের সম্পূরক শক্তি।
আমেরিকা এবং ইউরোপের আবরোধ আর ইসরাইলের হুমকি ধামকির বিরুদ্ধে ইরানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু রাশিয়া। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা শক্তিকে রুখতে আর ভূমধ্যসাগর এবং ভারত মহাসাগরে নামার জন্য ইরানকে ছাড়া রাশিয়ার কোনও উপায় নেই। তাই তারা অনেক আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে প্রায় একই বলয়ে আবস্থান করছে। যেমনটি দেখা গেছে সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং লিবিয়াতে। আর্মেনিয়ার সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক অনেক পুরাতন। আর্মেনিয়াকে রাশিয়া তার পশ্চাৎ বাগিচা হিসেবে দেখে।
দু’দেশের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামরিক এবং প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে। এই চুক্তির কারণে আর্মেনিয়াতে আক্রমণ হলে রাশিয়া সর্বশক্তি দিয়ে আর্মেনিয়াকে সাহায্য করতে বাধ্য। এক্ষেত্রে ইরান রাশিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে আজারবাইজানের পক্ষ নিতে পারে না। তুরস্ক ইস্যু তুরস্কের সাথে ইরানের সম্পর্ক সবসময়ই ছিল ঢিলে ঢালা। অন্যদের চাপে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আঙ্কারা ও তেহরান একে অপরকে সহযোগিতা করত। কিন্তু এই সম্পর্ক কখনই দহরম মহরম ছিলনা। একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলেই আবার শুরু করে দিত ঠোকরা-ঠুকরি।
বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের উত্থানের কারণে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আর সিরিয়াতে আঙ্কারা এবং তেহরান পরস্পর বিরোধী অবস্থান দু’দেশের সম্পর্কে একেবারে খাদের কিনারে নিয়ে গিয়েছিল। ফিলিস্তিনেও তুরস্ক ইরানের একক কর্তৃত্বে হাত দিয়েছে।
ইরাক, লেবানন, লিবিয়াতে ইরানের সুখের ঘর ভেঙ্গে দিয়ে তুরস্ক তেহরানকে যে চাপে রেখেছে তাতে তুরস্কের হাত শক্তিশালী হোক এমন কোনও পরিকল্পনা ইরান সফল হতে দিবে না। সুতরাং আজারবাইজান শক্তিশালী হলে তুরস্ক ককেশাশীয় অঞ্চলে নিজের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে সক্ষম হবে। যা ইরানের জন্য রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতির কারণ।
ইসরাইল ফ্যাক্টর ইরান এবং ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যসহ সব ক্ষেত্রেই আবস্থান করেছে পরস্পর বিরোধী মেরুতে। সেক্ষেত্রে আজারবাইজান আর ইসরাইলের সখ্যতা ইরানের সহ্য না হওয়ারই কথা।
বিশেষ করে গত কয়েক দশক ধরে আজারবাইজান ইসরাইলের কাছ থেকে যেভাবে অস্ত্র কিনে তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে তাতে স্বভাবগতভাবগত কারণেই ইরান ইসরাইলের বিরুদ্ধে তথা আজারবাইজানের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। এসব বিষয় পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আজারবাইজান ইস্যুতে ইরান শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে বা আবেগেতাড়িত হয়ে নয় বরং অনেক বিস্তৃত পরিসরে এবং বহুমাত্রিক হিসাবনিকাশ করেই খেলছে।
লাইটনিউজ