মনে করুন, হঠাৎ কোনো একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজে আপনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, আপনি সেখানে উপস্থিতই ছিলেন না! কেমন হবে ব্যাপারটা?
কিন্তু হ্যাঁ, এই অসম্ভবকে সম্ভব করতেই আগামী দিনগুলোতে আসছে DeepFake নামক নতুন প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির কথা আপনি হয়তো ইতোমধ্যেই শুনে থাকবেন। আর না শুনলেও সামনে যে এই প্রযুক্তি নিয়েই কথা হতে যাচ্ছে, সেটি হয়তো বুঝতে পেরেছেন।
‘ডিপফেক’ এমন একটি ফাঁদ (অ্যাপ) বা জালসমৃদ্ধ সিন্থেটিক ভিডিও বা অডিও রেকর্ডিং, যা দেখতে অবিকল আসল জিনিসটির মতোই দেখতে এবং বলতে শোনায় অর্থাৎ এর মধ্যে থাকা বিদ্যমান চিত্র বা ভিডিওতে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে সদৃশ্য অন্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সঙ্গে প্রতিস্থাপন করা হয়।
Machine Learning আর Artificial intelligence-এর সমন্বয়ে তৈরি DeepFake (Deep learning+ Fake) টেকনোলজি অনেকটা ছবি এডিট করার মতো একজনের শরীরে বা মাথায় আরেকজনের মুখ, অভিব্যক্তি, কণ্ঠস্বর এমনকি অঙ্গভঙ্গিকেও কপি করে নিখুঁত ভিডিও তৈরি করতে সক্ষম।
যদিও কোনো তথ্য বা ভিডিও নকল করা আজকাল নতুন কিছু নয়, তবে ডিপফেক হলো এমন একটি শক্তিশালী কৌশল, যা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্র ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যেকোনো ভিজুয়াল ইফেক্টের মাধ্যমে প্রতারণার জন্য অধিক দক্ষ ও কার্যকর পদ্ধতি।
ডিপফেক তৈরির জন্য যেসব প্রধান মেশিন লার্নিং পদ্ধতিগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলো মূলত সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ ও বিশদ শিক্ষা অর্জনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু জেনেরেটাল নিউরাল নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচার বেজড পদ্ধতি হলো অটোইনকোডারস বা জেনারেটর অ্যাডভারসিয়াল নেটওয়ার্ক (জিএএনএস)।
ডিপফেকের ব্যবহার এত দিন শৌখিন শখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পর্ন তারকাদের শরীরে বা মুখে সেলিব্রিটিদের শরীর বা মুখ লাগানো, রাজনীতিবিদদের মজাদার ভিডিও তৈরি, হাস্যকর ভিডিও বানানোই ছিল এর কাজগুলোর মধ্যে প্রধান। তবে, DeepFake এর চেয়েও বেশি বিপদজনক ও ভয়াবহ।
অ্যাডভান্স লেভেলের DeepFake ভিডিওতে চেহারার পাশাপাশি কণ্ঠস্বর নকল করাও সম্ভব। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্টের ভাষণ নকল করা, ভিডিও কনফারেন্সে জাল ভোট চাওয়া, বিয়ের নকল সঙ্গমের ভিডিও করে বিবাহ বিচ্ছেদ করানো, সাইবার নিরাপত্তায় হুমকি বার্তা প্রেরণসহ নানাবিধ কারণে বিষয়টি নিয়ে সতর্ক হওয়া জরুরি।
এটি একটি দেশকে মুহূর্তের মধ্যেই অভ্যন্তরীণভাবে প্রচণ্ড সংকট ও গভীরভাবে দুর্বল করতে যথেষ্ট। এছাড়াও পারমাণবিক অস্ত্র, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, ইন্টারনেট সিস্টেম, ব্যাংকিং সেক্টর, বৈদ্যুতিক গ্রিড, অবকাঠামো অ্যাক্সেসসহ নানাবিধ ক্রমবর্ধমান কাজে সিন্থেটিক জাল ভিডিও তৈরি করার দক্ষতা এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করতে পারে।
এটি শুধু সাধারণ মানুষকেই নয়, পরাক্রমশালী বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্টদেরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ওয়াশিংটনে ২০১৬ সালে রিপাবলিকান সিনেটর মার্কো রুবিও এটিকে পারমাণবিক অস্ত্রের সমতুল্য বলে অভিহিত করেন। সেখানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘হতাশ উচ্চাভিলাষ দ্বারা জর্জরিত রাজনৈতিক শক্তি বা ডিপফেকস কি সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়ে বড় হুমকি?’
তাছাড়া এটি দ্রুত সবার জন্য সহজলভ্য হয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ের Deepfake প্রোগ্রাম এতটা সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু বর্তমানে এমন কিছু অ্যাপস ও প্রোগ্রাম বেড়িয়েছে, যেখানে একজনের মুখে আরেকজনের মুখ ও এক্সপ্রেশন সহজেই বসিয়ে দেওয়া যাচ্ছে।
জনপ্রিয় ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যারগুলোর জন্য নানা নামে ডিপফেক প্লাগিন্স ক্রমাগত ইন্টারনেটে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাই আগে ভিডিওকে বিশ্বাস করলেও বর্তমানে ভিডিওকে বিশ্বাস করার আগে আরেকবার ভাববার অবকাশ রাখে।
লেখক: ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
লাইটনিউজ