মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার হয়েছেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। একাদশ জাতীয় সংসদের এ আইন প্রণেতা নিজেই অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন।
দেশের বাইরে গ্রেফতার হওয়ায় তার বিষয়ে দেশের আদালতে কিছুই করা যাচ্ছে না। জামিন নিতেও কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না এ আইন প্রণেতা। গ্রেফতার হওয়ার পর বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছিল, একজন আইন প্রণেতা যখন মানব পাচারের মতো অপরাধ করেন, তার সংসদ সদস্য পদ থাকে কি করে?
আসলে কি হতে পারে, এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আইনি ব্যাখা জানতে চাইলে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, একজন সংসদ সদস্য গ্রেফতার হলে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই।
আইনি ব্যাখা তুলে ধরে ডেপুটি স্পিকার বলেন, একজন সংসদ সদস্য যদি কোনো মামলায় দুই বছর বা তার বেশি সময়ের সাজাপ্রাপ্ত হন এবং সে সাজা যদি নৈতিকস্খলন হয়, আর সে বিষয়টি সরকার বা কোনো কর্তৃপক্ষ সংসদকে যদি অবহিত করে যে আপনার ওই আসনের অমুক এমপি এ মামলায় এ ধারায় এতো বছরের কারাদণ্ড হয়েছে এবং সেটাকে আমরা নৈতিকস্খলন বলে বিবেচনা করি, তখন সংসদ সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে কাগজপত্র দেখে তাকে তখন ‘ডিজমেম্বার’ (সংসদ সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার) করতে পারে। তার আগে দেখভাল করার কোনো সুযোগ সংসদের নেই।
অন্যদিকে কার্যপ্রাণালী বিধির ১৭২ বিধি অনুযায়ী, কোনো সদস্য ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হলে কিংবা কোনো আদালত কর্তৃক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে বা কোনো নির্বাহী আদেশক্রমে আটক হলে ক্ষেত্রমত গ্রেফতারকারী বা দণ্ডদানকারী বা আটককারী কর্তৃপক্ষ বা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী কর্তৃপক্ষ তৃতীয় তফসিলে প্রদত্ত যথাযথ ফরমে অনুরূপ গ্রেফতার, দণ্ডাদেশ বা আটকের কারণ বর্ণনাপূর্বক অবিলম্বে অনুরূপ ঘটনা স্পিকারকে জানাবেন।
এরপর কার্যপ্রণালী বিধির ১৭২ বিধি মোতাবেক পত্র পাওয়ার পর কার্যপ্রণালী বিধির ১৭৬ বিধি অনুযায়ী স্পিকার যত দ্রুত সম্ভব সংসদ অধিবেশনে থাকলে সংসদে তা পাঠ করবেন, কিংবা সংসদ অধিবেশন না চললে সদস্যদের অবগতির জন্য তা প্রচার করার নির্দেশ দেবেন।
তবে শর্ত হচ্ছে কোন সদস্যের জামিনে বা আপিলে খালাস হওয়ার সংবাদ যদি মূল গ্রেফতার সংসদকে জানানোর আগে পাওয়া যায়, তাহলে অনুরূপ গ্রেফতার বা পরবর্তী মুক্তি বা খালাসের সংবাদ স্পিকার সংসদকে না জানালেও চলবে।
সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল কুয়েতে গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি অফিশিয়ালি স্পিকারকে অবহিত করা হলে, তখন হয়তো তিনি সংসদ অধিবেশনে অবহিত করতে পারেন।
প্রসঙ্গত, মানবপাচার ও অর্থপাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৭ জুন কুয়েত ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) এমপি পাপুলকে আটক করে। তাকে দেশটির সিআইডি রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কুয়েত সিআইডি এসব অভিযোগ তদন্ত করে দেখছে। এছাড়া পাপুলের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ইতোমধ্যে কুয়েতের তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে। তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে কুয়েতের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, কাজী শহীদ ইসলামের বিরুদ্ধে মানবপাচার, অতিরিক্ত ভিসা নবায়ন ফি আদায়, কুয়েতের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত করছে কুয়েত সিআইডি। তার বিরুদ্ধে ১১ জন বাংলাদেশি সাক্ষিও দিয়েছেন।
এছাড়া পাপুলের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের চেকবই জব্দ করেছে সিআইডি। একই সঙ্গে কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ৬ জুলাই। সে কারণে আগামী ৬ জুলাই পর্যন্ত তাকে আটকই থাকতে হবে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, একজন গ্রেফতার হলেই তার এমপি পদ বাতিল করা যায় না। আগে তার সাজা হতে হবে। সেখানে সাজার বিষয়ে দুই বছরের কথা বলা আছে। তাছাড়া আইনগতভাবে এখন কিছু করার সুযোগ নেই।
পাপুলের ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, অতীতে এ রকম ঘটনা আমাদের এমপিদের ক্ষেত্রে হয় নাই। তবে বর্তমান সংসদে এ ধরনের ফৌজদারি অপরাধের (ক্রিমিনাল অফেন্স) সঙ্গে অনেক ব্যবসায়ী জড়িত আছেন। কারণ এখন সংসদ হয়েছে ব্যবসায়ী নির্ভর আর ওইসব ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত। কাজেই সরকারের সর্তক হওয়া দরকার। এ ধরনের ব্যবসায়ী, যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের যেন সংসদে না আনা হয়। এ রকম হলে ভবিষ্যতে মানি লন্ডারিংসহ অন্যান্য অনেক অপরাধের সঙ্গে অনেক এমপি জড়িয়ে যাবেন।
এজকন এমপি হিসেবে পাপুল দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্র যদি এখনই সর্তক না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরো ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। সাজা না হওয়া পর্যন্ত তার সদস্য পদ বাতিল করার কোনো এখতিয়ার নেই। তবে সরকারের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া। একজন ক্রিমিনাল অফেন্সের সাথে জড়িত, যা অনৈতিকই না শুধু, এটা রাষ্ট্রের সাথে মারত্মক শৃঙ্খলা পরিপন্থি, ইথিকসের বাইরে সবকিছুই ঘটেছে এমপি পাপুলের বেলায়। প্রকৃত রাজনীতিবিদরা এ ধরনের অপরাধ করেন না। যারা করছেন, তারা প্রত্যেকেই ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিবিদ। কাজেই রাষ্ট্রের আরো সতর্ক হওয়া দরকার, না হলে সব সময় রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এভাবে ক্ষুণ্ন হতে পারে। আর একটা বিষয় আছে, কোনো এমপি টানা ৯০ কার্য দিবস অনুপস্থিত থাকলে স্পিকার চাইলে তার সদস্য পদ বাতিল করতে পারেন।
এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, আমরা এখনো কুয়েতের কাছ থেকে সরকারিভাবে কোনো তথ্য পাইনি। পত্রিকায় যেসব তথ্য পেয়েছি, সরকারিভাবে কুয়েতের কাছ থেকে এসব তথ্য পেলে আইন অনুযায়ী অবশ্যই তার বিচার হবে। তথ্য না পেলে তো আমাদের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।
লাইট নিউজ