নবীজির যুগে কাফের-মুশরিকরা পবিত্র কোরআনের বিরোধিতা করলেও গোপনে সেই কোরআনেরই মুগ্ধ শ্রোতা ছিলো তারা। নবীজি যখন প্রকাশ্যে নামাজে কোরআন তেলাওয়াত করতেন তখন তারা দূরে সরে যেত। কিন্তু দূর থেকে ঠিকই আড় কানে চুপিচুপি শোনার চেষ্টা করত। যখন কেউ দেখে ফেলত, আস্তে করে কেটে পড়ত। (আলবিদায়া ওয়াননিহায়া: ৪/১৬৪)
রাতের অন্ধকারে তাদের কোরআন তেলাওয়াত শোনার আগ্রহ বেড়ে যেত। নবীজি সাধারণত দিনের বেলা দ্বীনের দাওয়াত দিতেন আর রাতে নিভৃতে নামাজে তেলাওয়াতে দাঁড়িয়ে যেতেন। তখন মক্কার সবচেয়ে বড় কাফের আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান ও আখনাস ইবনে শারিকের মতো মুশরিক
সরদাররা লোকচক্ষু ফাঁকি দিয়ে চলে আসত নবীজির কোরআন তেলাওয়াত শুনতে। নবীজির ঘরের বাইরে ঘাপটি মেরে বসে কান পেতে থাকত তারা। কারো কথা কেউ জানত না।
এভাবে সারারাত তন্ময় হয়ে কোরআন তেলাওয়াত শুনত তারা। একবার তেলাওয়াত শুনতে শুনতে ভোর ঘনিয়ে এল। অপ্রস্তুত অবস্থায় মুখোমুখি হয়ে গেল তিন জন। সবাই সবার কাছে ধরা খেয়ে গেল। তিনজনই একই অপরাধের অপরাধী! দিনভর যেই কোরআনের বিরোধিতায় তারা জোর
প্রচারণা চালায় তারাই কি না রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর অন্তরালে এভাবে কোরআন শুনতে আড়ি পেতে বসে! সাধারণ জনতা ব্যাপারটা টের পেলে কোরআনের প্রতি আরো ধাবিত হয়ে পড়বে! জনগণকে যেভাবে তারা ভুলভাল বুঝিয়ে কোরআনের সংস্পর্শ থেকে নিবৃত্ত রাখতে চাইছে, তা মাঠে মারা পড়বে। এরকম আর আসা যাবে না, তারা তিনজনেই প্রতিজ্ঞা করল। নিজেদের ভর্ৎসনা করে তারা ঘরে ফিরে গেল।
দিন গড়িয়ে রাত এল। চারিদিকে অন্ধকার। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে চিন্তা করল, কাল যেহেতু সবাই ধরা পড়ে গিয়েছে তাই আজ তেলাওয়াত শুনতে কেউ যাবে না। আমি একা গিয়ে কিছুক্ষণ শুনে আসি। এভাবে তিনজনই একই চিন্তা নিয়ে প্রতিজ্ঞা ভেঙে চলে গেল কোরআন শুনতে। ভোরের আলো ফুটতেই আবারও একে অপরের হাতে ধরা পড়ে গেল। এবারও আগের দিনের মতো নিজেদের ভর্ৎসনা করে যে যার মতো ঘরে চলে গেল। ওয়াদা করল আর আসবে না।
তৃতীয় রাতেও তারা কেউ বিছানায় থাকতে পারল না। অন্ধকার নেমে এলে লুকিয়ে লুকিয়ে আবারও চলে গেল কোরআন শুনতে। বরাবরের মতো দেখা হয়ে গেল তিনজনের। এখন তারা শক্ত হলো। বললো, আমরা মজবুত প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ না হলে হবে না। এভাবে তারা পরস্পর অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ঘরে ফিরল। (সিরাতে ইবনে হিশাম: ১/৩১৫; দালায়েলুন নুবুওয়াহ, বায়হাকি: ২/২০৬; তাফসিরে ইবনে কাসির: ৫/৭৭)
আসলে এটি কোরআনের মোজেজা। তেলাওয়াত শুনলে অন্তরে একটা আলাদা অনুভূতি তৈরি হয়। যে সমাজে কোরআন অপরিচিত, সে সমাজের মানুষ যখন হঠাৎ কোরআনের তেলাওয়াত শোনেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকেন। অর্থ না বুঝেই এই অবস্থা হয় শুধুমাত্র সুরে। এমন ঘটনা
হরহামেশাই দেখা যায়। এসব ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এসব আসলে মহান স্রষ্টার কালামের প্রভাব।
কিন্তু কোরআনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো—কেউ যদি হেদায়েত চায়, তাহলে সে কোরআন থেকে হেদায়েত পায়, আর যে বিপরীত কিছু খোঁজে, তাহলে কোরআন তাকে তা-ই দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ এই কোরআনের মাধ্যমে অনেককে পথভ্রষ্ট করেন আবার অনেককে পথ প্রদর্শন করেন। এর মাধ্যমে কেবল ফাসেকদেরই পথভ্রষ্ট করে থাকেন। (সুরা বাকারা: ২৬)