বগুড়ার মহাস্থানগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের প্রথম পর্যায়েই সন্ধান পাওয়া গেছে প্রাচীন আমলের সিলিং বা সিলের। প্রাচীন লিপিযুক্ত এই সিলে থাকা লিপির পাঠোদ্ধার করা গেলে ধারণা পাওয়া যাবে সেটা কোন আমলের এবং কী কাজে ব্যবহৃত হতো। খননের সময় মাটির যে স্তরে সিল পাওয়া যায়, প্রায় একই স্তর থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি পোড়ামাটির নারী অবয়বের মাথা। ধারণা করা হচ্ছে, সেটি গুপ্ত-পরবর্তী সময়ের, অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন।
এবারের খননে মূলত একটি বৌদ্ধ মন্দির কমপ্লেক্সের সন্ধান চালানো হচ্ছে। যে স্থানে খনন হচ্ছে তার সঙ্গেই দক্ষিণাংশে আগের খননে একটি মন্দির কমপ্লেক্সের সন্ধান পাওয়া যায়। এবার অন্য মন্দির কমপ্লেক্স পাওয়া গেলে সেখানে পাশাপাশি দুটি বৌদ্ধ মন্দিরের অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যাবে।
বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ের বৈরাগীরভিটায় গত ১ মার্চ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ শুরু হয়। খননকাজ আরো এক মাস চলবে বলে জানিয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। সেই হিসাবে এখন প্রায় প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে খননকাজ। এরই মধ্যে সেখানে দুটি বৌদ্ধ স্তূপ (সমাধিসৌধ), প্রাচীন লিপিখচিত সিল, পোড়ামাটির নারী অবয়বের মাথা, অলংকৃত ইট, ভগ্ন মৃৎপাত্রসহ বিভিন্ন প্রত্নসামগ্রীর সন্ধান মিলেছে। পুরো খনন সম্পন্ন হলে সেখানে প্রাচীন স্থাপত্য কাঠামো ছাড়াও অনেক প্রত্নসামগ্রীর সন্ধান মিলবে বলে ধারণা খননকাজে নিয়োজিতদের।
প্রাচীন দুর্গনগরী মহাস্থানগড়ের জাহাজঘাটা থেকে দক্ষিণে এবং পরশুরাম প্যালেসের উত্তরে বৈরাগীভিটার অবস্থান। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক কে এন দীক্ষিতের নেতৃত্বে ২০ শতকের শুরুতে ১৯২৮-২৯ সালে প্রথম এই ভিটায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন হয়। ইতিহাসের লুকানো রহস্য জানতে এবং এটি দর্শকদের সামনে উপস্থাপনের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সেখানে আরো খননের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৬ থেকে আবার খননকাজ শুরু হয়। গত তিন বছর করোনা মহামারির কারণে খনন বন্ধ থাকলেও এবার ফের এই ভিটায় খনন শুরু হয়েছে।
চলতি খননকাজে ফিল্ড পরিচালক রয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা। মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টডিয়ান রাজিয়া সুলতানা এই খননকাজে দলনেতা হিসেবে রয়েছেন। এ ছাড়া খননকাজে যুক্ত রয়েছেন রংপুরের তাজহাট জাদুঘরের কাস্টডিয়ান হাবিবুর রহমান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রধান নকশা অঙ্কনকারী আফজাল হোসেন মণ্ডল, সহকারী কাস্টডিয়ান হাসনাত বিন ইসলাম, আলোকচিত্রী আবুল কালাম আজাদ, সার্ভেয়ার মুর্শিদ কামাল ভূঁইয়া ও আলোকচিত্র মুদ্রাকর দিদারুল আলম। স্থানীয়ভাবে নির্ধারিত ১৬ জন শ্রমিক এই দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন খননকাজে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা জানান, এখানে খননের মাধ্যমে আরো প্রাচীন প্রত্ন নিদর্শন তথা ইতিহাসের অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিগত সময়ের খননে উন্মোচিত বৌদ্ধ মন্দিরের ঠিক উত্তর পাশেই আরেকটি প্রাচীরের নিদর্শন বেরিয়ে এসেছে, যা পাল আমলের বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রাচীরটি সম্ভবত আরেকটি বৌদ্ধ মন্দির কমপ্লেক্সের। সেই প্রাচীরের বেষ্টনীর সন্ধান করতেই এখন খনন পরিচালনা করা হচ্ছে। সেটি পূর্ণাঙ্গরূপে উন্মোচিত হলে বলা যাবে যে সেখানে পাশাপাশি দুটি মন্দির ছিল। এরই মধ্যে সেখানে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীকে খুবই মূল্যবান উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে সিলটি পাওয়া গেছে তার পাঠোদ্ধারের জন্য এরই মধ্যে সিলের ছবি তিনি বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে রিপোর্ট পেলে সিলটির সময়কাল এবং তাতে লিপিবদ্ধ বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা পাওয়া সম্ভব বলে জানান তিনি।