করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন কার্যকরে প্রস্তুত সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত এলাকার সীমানা নির্ধারণ করে তারা মাঠে নামবেন।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৪৫টি এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২৮টি এবং উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৭টি এলাকা আছে। তবে এসব এলাকার কোন কোন স্থান লকডাউনের আওতায় আসবে তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে চিহ্নিত এলাকায় অবরুদ্ধ অবস্থা কার্যকর হয়নি। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে রাজধানীর প্রথম রেড জোন পূর্ব রাজাবাজারে এক সপ্তাহ ধরে চলছে লকডাউন। দিনে দিনেই পরিবর্তন হচ্ছে এ এলাকার বাসিন্দাদের চাহিদা। শুরুতে চাল, ডাল আটা, কাঁচাবাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা থাকলেও সময়ের ব্যবধানে এসবের সঙ্গে যোগ হচ্ছে অনেক কিছু। ২০ ভাগ মানুষ এখনও অসচেতন বলে জানিয়েছেন পূর্ব রাজাবাজারের স্বেচ্ছাসেবীরা। অনেকেই অবরুদ্ধ অবস্থা মানতে চান না। তারা নানা অজুহাতে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। তারা বলেন, পূর্ব রাজাবাজার হচ্ছে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়নের পাইলট প্রকল্প। এখানে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে লকডাউন বাস্তবায়ন করছেন। বড় অভিজ্ঞতা হচ্ছে লকডাউন বাস্তবায়নে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সেভাবেই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
মঙ্গলবার বিকালে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, লকডাউনের অঞ্চল ঘোষণা করা হলেও এখনও সীমানা নির্ধারণ হয়নি। লকডাউনের জন্য এলাকাগুলোর সুনির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিত হওয়ার পর আমরা মাঠে নমব। এরই মধ্যে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। অতীতের ভুল-ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়নে র্যাবের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে আমরা কঠোর হব।
আইএসপিআরের পরিচালক আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ বলেন, কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির বিবেচনায় ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেশের যেসব অঞ্চলে জনসাধারণের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, সেসব এলাকায় সেনা টহল জোরদার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়নে আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছি। ফোর্স ও পিপিই রেডি করছি। সেনা মোতায়েনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা নতুন কোনো কাজ করছি না। এসব করে আমরা অভ্যস্ত। আমাদের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের সরকার যে ধরনের কাজ দেবেন তা বাস্তবায়নে আমরা সদাপ্রস্তুত। করোনাযুদ্ধে জয়ী হতে আমাদের যা করার সবই করব। কাজ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। ভবিষ্যতে হবে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার ওয়ালিদ হোসেন বলেন, অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন কার্যকরে আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছি। সিটি কর্পোরেশন থেকে সবকিছু সমন্বয় করা হচ্ছে। অতীতে সেভাবে লকডাউন কার্যকর হয়নি।
বলা চলে যানবাহন ও মানুষের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। এবারের অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে। সেক্ষেত্রে এলাকাগুলো সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। এলাকার কোন রাস্তা, কোন গলি, কোন বাড়ি লকডাউনের আওতায় থাকবে তা নির্দিষ্ট করা হলে পুলিশের কাজে সুবিধা হবে।
স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ক মাসুদ হোসেন সুমন বলেন, লকডাউন বাস্তবায়নে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছি। এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে দিন দিনই চাহিদার পরিবর্তন হচ্ছে। তামাশা করতেও অনেকে ফোন দিচ্ছে। রাত ৩টায় ফোন করে বলছে, আমার মুরগি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। একটি ব্রয়লার মুরগি লাগবে। রাত ১২টায় ফোন করে কেউ বলছে, আমার বোনের একটি ক্রিম লাগবে। রাত ১১টায় ফোন করে বলা হচ্ছে আমার একটি জর্দার কৌটা লাগবে, এক পিস সিগারেট লাগবে। ফাস্টফুড খাওয়ার জন্য ফোন করছেন কেউ কেউ। এসব কোনোভাবেই মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না।
আমাদের কষ্ট হলেও এসব চাহিদা পূরণ করছি। কারণ এলাকাটি অঞ্চলভিত্তিক লকডাউনের টেস্ট কেস, তাই যে কোনো মূল্যেই আমরা সুষ্ঠুভাবে এর বাস্তবায়ন করতে চাই। এলাকাবাসীদের বলেছি, আপনাদের যদি একটি সুঁইয়েরও প্রয়োজন হয় সেটা আমরা সরবরাহ করব। কিন্তু আপনাদের কাছে একটিই দাবি- আপনারা ঘরে থাকুন। আমাদের সেবাটা গ্রহণ করুন।
স্বেচ্ছাসেবী সাব্বির আহমেদ মাসুম বলেন, আমরা প্রথমে মনে করেছিলাম মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারলে তাদের ঘরে রাখা যাবে। এতেই লকডাউন কার্যকর হবে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যাকে আমি চাল, ডাল, পেঁয়াজ, লবণ, আলু দিচ্ছি তিনি বলছেন, আমার একটি বার্গার বা পিৎজা লাগবে। তার একটি পাকা চাপাকলা লাগবে। চাপাকলা দেয়ার পর বলছে, এক বাচ্চা চাপাকলা খেতে চাচ্ছে না। তার জন্য সাগরকলা লাগবে।
সিগারেটের ক্ষেত্রে লাল বেনসন দেয়া হলে বলছে সাদা বেনসন লাগবে। অসচেতন অনেকেই স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর সব দোষ চাপিয়ে বলছেন, আমাদের সব চাহিদা পূরণ করতে না পারলে লকডাউন দিচ্ছেন কেন? তারা বুঝতে চাচ্ছে না যে, তাদের ভালোর জন্যই লকডাউন দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, একজন ডাক্তার হাসপাতালে সেবা দিয়ে আসার পর দেখা যাচ্ছে গ্লাভস ছাড়াই বাইরে থেকে খাবার নিয়ে রেড জোনে ঢুকছে। তখন তাকে কী বলা উচিত?
পূর্ব রাজাবাজারের অভিজ্ঞতা অন্য এলাকার লকডাউনের ক্ষেত্রে কিভাবে কাজে লাগবে জানতে চাইলে স্বেচ্ছাসেবী মনোয়ার হাসান সোহেল বলেন, কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। নিজেদের টাকা ইনভেস্ট করেও সেবা দিতে হয়। সেই বিষয়টিও লকডাউন বাস্তবায়নকারীদের মাথায় রাখতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দিচ্ছি। আমাদের একটি গ্রুপ অনলাইনে খুবই পারদর্শী। যে কারণে অনলাইনে সেবা দেয়া সহজ হচ্ছে। তাই অন্য এলাকার জন্যও দক্ষ অনলাইন গ্রুপ তৈরি করতে হবে। ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবীর জন্য বিশেষ ট্রেনিং দিয়েছি। করোনাভাইরাসের যেহেতু কার্যকর ওষুধ নেই তাই প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবী খুবই জরুরি।
লাইটনিউজ/এসআই