ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের দুই বছর পূর্ণ হলো আজ, যা গাজায় নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ, মানবিক বিপর্যয় ও বিপুল প্রাণহানি ঘটিয়েছে। এই রক্তাক্ত প্রেক্ষাপটে একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে একদিকে যেমন গাজায় চলমান হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের অবসান ঘটতে পারে, তেমনি অন্যদিকে হামাসের হাতে থাকা জীবিত ও মৃত ইসরায়েলি জিম্মিদেরও তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
তবে, এই সংঘাতের দুই প্রধান পক্ষ— হামাস ও ইসরায়েল এত বড় একটি মানবিক ও রাজনৈতিক সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছাবে কি না, তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। (খবর বিবিসির)
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় প্রায় এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন ও ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। ইসরায়েল এখনো ২০ জন জিম্মিকে জীবিত ও আরও ২৮ জনের মৃতদেহ ফেরত চায়।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের সামরিক প্রতিক্রিয়ায় গাজার বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। ৬৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৮ হাজারেরও বেশি শিশু। হামাস প্রশাসনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই পরিসংখ্যান সাধারণত নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত। অন্যদিকে গাজার ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি মানবিক বিপর্যয় ও মানুষ সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে।
ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয়ই যুদ্ধ শেষ করতে চায়। ইসরায়েলিরা যুদ্ধে ক্লান্ত। জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষ এমন একটি চুক্তি চায় যা জিম্মিদের ফিরিয়ে দেবে ও যুদ্ধের অবসান ঘটাবে।
হামাস একটি সুসংগত সামরিক সংগঠন হিসেবে ভেঙে গেলেও এখন তারা শহুরে গেরিলা বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। তারা ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাটদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে ও তাদের ভারী অস্ত্রের অবশিষ্টাংশ হস্তান্তর বা ভেঙে ফেলতে স্বীকার করেছে।
তবে, তারা প্রতিশোধ নিতে পারে এমন অন্যান্য ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র রাখতে চায়। সংগঠনটি চায় এমন শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে, যা তাদের নামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
ইসরায়েল চায় হামাসকে দিয়ে আত্মসমর্পণের শর্তগুলো নিজেদের মতো করে ঠিক করতে। তবে, হামাসের পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে ভালো। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সময় দোহার যে ভবনে হামলা হয়েছিল, সেই হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া সিনিয়র নেতা খলিল আল-হাইয়া এখন মিশরের শার্ম আল-শেখের আলোচনায় হামাস প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতে চান। দুর্নীতির বিচার স্থগিত রাখতে, নির্বাচনে জয়ী হতে ও ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ভুলের জন্য দায়ী নেতা হিসেবে পরিচিত হতে না চাওয়াই তাঁর প্রধান লক্ষ্য।
এসব অর্জনের জন্য তাঁকে ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ ঘোষণা করার একটি বিশ্বাসযোগ্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে, যার অর্থ তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেন— জিম্মিদের প্রত্যাবর্তন, হামাসের ধ্বংস ও গাজার সামরিকীকরণ।
এই আলোচনার ভিত্তি হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনা। ট্রাম্প দ্রুত ফলাফল চান ও ইসরায়েল-সৌদি আরব পুনর্মিলনের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুনরুজ্জীবিত করতে চান। সৌদি আরব স্পষ্ট করে দিয়েছে, একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্পষ্ট ও অপরিবর্তনীয় পথ ছাড়া এটি সম্ভব নয়।
ট্রাম্প আমেরিকান সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা ব্যবহারের মাধ্যমে নেতানিয়াহুকে তাঁর ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করাতে আরও কঠোর হচ্ছেন। তিনি হামাসকে তাদের পরিকল্পনায় যোগ দিতে অস্বীকার করলে ধ্বংসের হুমকি দিয়েছেন।
ট্রাম্প নিশ্চিত করেছেন, নেতানিয়াহু সামরিক অভিযান বন্ধ করতে রাজি হয়েছেন। হামাস যদি ট্রাম্পকে সব জিম্মিকে ফিরিয়ে নিয়ে বিজয় দাবি করার সুযোগ দেয়, তাহলে ট্রাম্প যুদ্ধ শেষের বিষয়টি নিশ্চিত করবেন বলে কাতারীরা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছে।
এই আলোচনা জর্ডান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী ভূমির নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দীর্ঘ সংঘাতের অবসান ঘটাবে না। এতে পশ্চিম তীরের ভবিষ্যৎও উল্লেখ করা হয়নি।
প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ হলো— ইসরায়েলি কারাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি ও বিনা বিচারে আটক গাজার নাগরিকদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির জন্য পরিস্থিতি তৈরি করা।
যদি মিশরে এই আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে উভয় পক্ষের সামরিক কমান্ডার ও অতি-জাতীয়তাবাদী চরমপন্থিরা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে। ফলে এই ভয়াবহ সংঘাত শেষ করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।