করোনা ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে সরকারি হিসাবের চেয়ে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬৭২ জন।
আর উপসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। যা সরকারি হিসাবের বাইরে। এদের উপসর্গ ছিল, কিন্তু পরীক্ষা করাতে না পারায় করোনা নিশ্চিত হয়নি।
সংক্রমণ নিশ্চিত করতে, চিকিৎসাসেবা পেতে রোগীর স্বজনরা হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু পরীক্ষাও করাতে পারেননি, পাননি চিকিৎসাও।
এ ধরনের রোগীর অধিকাংশই অশেষ কষ্ট ভোগ করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। এরপর তাদের দেহে কোভিড-১৯’র সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর কথা বলা মানে এক প্রকার দায় এড়ানোর চেষ্টা করা। কারণ উপসর্গ নিয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তারা মূলত করোনায় মারা গেছেন।
যখন একটি দেশে মহামারী বিরাজ করে, তখন উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু- এ কথা বলার কোনো যৌক্তিকতা থাকে না।
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুসতাক হোসেন বলেন, উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মন্তব্য হল- তারা মূলত এই রোগেই মারা গেছেন।
তবে উপসর্গগুলো পর্যালোচনা করে একজন চিকিৎসককে এ মন্তব্য করতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, উপসর্গ নিয়ে মৃতদের মধ্যে ৮৮ জনের (২৩ ভাগ) কোনো রকম নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি, ২৯৮ জনের (৭৭ ভাগ) নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল।
এই ২৯৮টি নমুনার মধ্যে ২৬৫টি (৮৯ ভাগ) সংগৃহীত হয়েছে মৃত্যুর পরে। আর মাত্র ৩৩টি নমুনা (১১ ভাগ) সংগৃহীত হয়েছে মৃত্যুর আগে।
অর্থাৎ ৩৮৬ জনের মধ্যে মাত্র ৩৩ জনের (৮.৬ ভাগ) থেকে জীবিত অবস্থায় নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এই রোগীদের ১৩.৯৩ ভাগের মৃত্যু হয় ভর্তি হওয়ার মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যে।
৬ ঘণ্টার মধ্যে (কিন্তু ১ ঘণ্টার বেশি) মৃত্যু হয় ২১.৩১ ভাগ রোগী, ৬ ঘণ্টা থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয় ২২.১৩ ভাগ, আর ১২ ঘণ্টা থেকে ১ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয় ২৩.৭৭ ভাগ। অর্থাৎ হাসপাতালের করোনা বা আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তির প্রথম দিনেই মারা গেছেন ৮১.১ ভাগ রোগী, আর ১ থেকে ২ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয় ১০.৬৬ ভাগ।
উপসর্গ নিয়ে মৃতদের মধ্যে ১৪ জনকে (৩.৯০ ভাগ) বাসার বাইরে রাস্তার ধারে, মসজিদে, বাজারে, উপকূলে, চা বাগানে, বাসার সামনে, হাসপাতালের বাইরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
ক্ষেত্রবিশেষ লাশ দীর্ঘ সময় ওভাবেই পড়ে ছিল। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাশ উদ্ধারের আগে কেউই মৃত দেহের কাছেও যায়নি। অথচ একটু উদ্যোগ নেয়া হলে তাদের শেষ সময়টা অন্যরকম হতে পারত।
৮ মার্চ থেকে ১৩ মে পর্যন্ত উপসর্গ নিয়ে ৯২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ (সিজিএস)।
ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি এবং সিজিএস ১৩ মে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এরপর ১ জুন পর্যন্ত আরও অর্ধশত মানুষ মারা গেছেন উপসর্গ নিয়ে। ফলে উপসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যা প্রায় এক হাজার বলে জানা গেছে।
এদিকে নেদারল্যান্ডসের ‘গ্রোনিনগেন ইউনিভার্সিটি’তে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও গবেষকদের একটি দল বাংলাদেশে করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতদের ওপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ৩০ এপ্রিল।
৮ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত মৃত্যুর ঘটনাগুলোর নানাবিধ তথ্য বিশ্লেষণ করে সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।
এই দলটি ৮ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সর্বমোট ৩৮৬টি মৃত্যুর ঘটনা সংকলিত করে। এখানে তারা দেখান, করোনা উপসর্গে মার্চে মারা গেছেন ৭৩ জন এবং এপ্রিলে ৩১৩ জন।
যদিও ওই সময়ে সরকারি হিসাবে কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৬৮ জনের। এর মধ্যে মার্চে (১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত) মারা গেছেন ৫ জন এবং এপ্রিলে মারা গেছেন ১৬৩ জন।
করোনা উপসর্গ হিসাবে ৩৭টি মৃত্যুর ক্ষেত্রে পৃথক উপসর্গ বা লক্ষণ উল্লেখ করা হয়নি। তবে বাকি ৩৪৫টি মৃত্যুর ঘটনায় ১৬টি লক্ষণের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টের বাইরেও যেসব লক্ষণ দেখা গেছে সেগুলো হচ্ছে- সর্দি, ডায়রিয়া, গলাব্যথা, ঠাণ্ডা, বুকে ব্যথা, বমি, মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা, খিঁচুনি, পেটব্যথা, আমাশয় ও কানে ব্যথা, নাক দিয়ে রক্তপাত।
মৃত ৩৪৫ জনের মধ্যে ২৬৮ জনেরই জ্বর ছিল, ২৩৫ জনের ছিল শ্বাসকষ্ট, ১৩৮ জনের ছিল সর্দির লক্ষণ ছিল। জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও সর্দি- এই চার লক্ষণের কমপক্ষে দুটি ছিল ২৪৬ জনের, কমপক্ষে তিনটি ছিল ১৪৯ জনের।
করোনা উপসর্গে সারা দেশে মৃতদের মধ্যে ২৬৫ জন পুরুষ এবং ১০৯ জন নারী (১১ জনের তথ্য পাওয়া যায়নি)। অর্থাৎ শতকরা ৭১ ভাগ পুরুষ ও ২৯ ভাগ নারী।
তবে সরকারি হিসাবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে যে ১৬৮ জনের মৃত্যু হয়, (এপ্রিল পর্যন্ত) তার মধ্যে শতকরা ৭৩ ভাগ পুরুষ ও ২৭ ভাগ নারী।
কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়া মৃতদের মাঝে ২ শতাংশের মৃত্যু ঘটেছে ১০ বছর কম বয়সী শিশুর। করোনা উপসর্গে মৃতদের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি, ৬ শতাংশ।
৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ২০ জন শিশু করোনা উপসর্গে মারা গেছে। ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী মারা গেছে ২৪ জন বা ৭.৬ শতাংশ।
এছাড়া ৪০-৪৯ ও ৫০-৫৯ বছর বয়স গ্রুপে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে, যথাক্রমে ৬০ ও ৬২ জন। শতকরা হারে ১৯ শতাংশ।
কোভিড-১৯ পজিটিভে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৪১-৫০ বছর বয়স গ্রুপেও মৃত্যুর হার ১৯ শতাংশ, যা করোনা উপসর্গে ৪০-৪৯ বছর বয়স গ্রুপের মৃত্যুহারের সমান।
৬০ বছরের বেশি বয়স গ্রুপে কোভিড-১৯ পজিটিভে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, ৪২ শতাংশ। তবে উপসর্গে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মৃত্যুহার ২২ শতাংশ।
গ্রোনিনজেন ইউনিভার্সিটি গবেষকরা জানান, করোনা উপসর্গে মৃত ১৩২ জনের কোনো পেশাগত তথ্য পাওয়া যায়নি।
বাকি ২৫৪ মৃত ব্যক্তির পেশাগত তথ্যে দেখা গেছে, এর মধ্যে কৃষক, নানা ধরনের শ্রমিক (গার্মেন্ট শ্রমিক, চা শ্রমিক, দোকান শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, ইটভাটা শ্রমিক, গৃহ শ্রমিক, স্টিল শ্রমিক), চালক (রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ট্রলিচালক, সিনজিচালক), জেলে, মাঝি এবং দিনমজুর মারা গেছেন ৬৭ জন (২৬.৪ শতাংশ)।
এছাড়া শিশু, বৃদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, কর্মক্ষম নন এমন প্রতিবন্ধী মারা গেছেন ৫০ জন। এরপর গৃহিণী মারা গেছে ৩৭ জন (১৪.৬ ভাগ), শিক্ষার্থী মারা গেছে ২৩ জন (৯.০১ ভাগ)।
বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী (কাপড় ব্যবসায়ী, দোকান ব্যবসায়ী প্রভৃতি) মারা গেছেন ১৮ জন। নানা ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিক্রেতা (মাছ বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা, ডিম বিক্রেতা, হকার ও ফেরিওয়ালা) মারা গেছেন ১১ জন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারী মারা গেছেন ১৪ জন।
চিকিৎসক, ডেন্টাল সার্জনসহ স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন ৭ জন, শিক্ষক ৬ জন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের কর্মকর্তা মারা গেছেন ৫ জন, পুলিশ, আনসার, নৌবাহিনীর সদস্য মারা গেছেন ৪ জন এবং সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী মারা গেছেন ৩ জন।
৮ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৬১টি জেলায় করোনা উপসর্গে মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি ২৫ জন মারা গেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলায়।
দেশে সংক্রমণ শনাক্তের ওই দুই মাসেই ১০ বা ১০ এর বেশি ব্যক্তি করোনা উপসর্গে মারা গেছেন, সেসব জেলা হচ্ছে- লক্ষ্মীপুর, শরীয়তপুর, পটুয়াখালী, ময়মনসিংহ, বগুড়া, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা ও চট্টগ্রাম।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে ১৫ জন নারায়ণগঞ্জ সদরে। এরপর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় ৮ জন করে মৃত্যু হয়।
মৃতদের মধ্যে ১৫৬ জন করোনাভাইরাসের উপসর্গে নিজ বাড়িতে, শ্বশুরবাড়িতে, স্বামীর বাড়িতে, বাবার বাড়িতে, ছেলে বা মেয়ের বাড়িতে, কিংবা ভাড়া বাসা বা কর্মস্থলের বাসায় মারা গেছেন।
বাসায় যে ১৫৬ জন মারা যান, তার সিংহ ভাগ অর্থাৎ ৬৪.৭৪ ভাগ বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন।
১৪.১০ ভাগ স্থানীয় চিকিৎসক, পল্লী চিকিৎসক, কবিরাজ, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, এমনকি তান্ত্রিক চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন কিংবা জ্বর, সর্দি, কাশির ওষুধ খেয়েছিলেন।
১২.৮২ ভাগ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার পর তারা মারা যান।
৭.০৫ ভাগ হোম কোয়ারেন্টিনে বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। আর ১.২৮ ভাগ এক বা একাধিক হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান।
লাইটনিউজ/এসআই