নরেন্দ্র মোদি জমানার বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসসহ বাকি দলগুলোর তফাতটা কোথায়? কুইজ মাস্টার এই প্রশ্ন করলে চটজলদি উত্তর হবে অতিসংক্ষিপ্ত। বাকি সব দল পরিস্থিতির বিচারে সক্রিয় হয়, বিজেপি সক্রিয় ১২ মাস ৩৬৫ দিন। এই উত্তরের সঙ্গে ছোট্ট একটা ফুটনোটও জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। যেসব পরিস্থিতি অন্য দলকে সক্রিয় করে তোলে, সেগুলোর কোনো কোনোটি বিজেপিরই সৃষ্টি।
সংক্ষেপে, বিজেপি ইস্যু তৈরি করে, অন্যরা তার প্রতিক্রিয়া দেখায়। মোকাবিলার চেষ্টায় নামে।
বিজেপি যে ৩৬৫ দিন সক্রিয়, করোনা নামক মহামারির এই সময়ে তার বেশ কয়েকটা প্রমাণ দেওয়া যায়। এই করোনাকালে গোটা দেশ ও প্রত্যেক মানুষ সব ভুলে যখন স্রেফ শারীরিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাঁচার চেষ্টায় ব্যস্ত, বিজেপিতে কিন্তু তখন বিন্দুমাত্র ঢিলেমি নেই। সক্রিয়তার প্রথম উদাহরণ আসন্ন রাজ্যসভার ভোট।
রাজ্যসভার দ্বিবার্ষিক নির্বাচনের দিন স্থির হয়েছিল ২৬ মার্চ। ১৮ মার্চ ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। ওই দিন দেখা যায়, ১৭ রাজ্যের মোট ৫৫ আসনের মধ্যে ১০ রাজ্যের ৩৭ জনের বিরুদ্ধে কোনো প্রার্থী নেই। অতএব ওই প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যান। বাকি ১৮ জন প্রার্থীর ভোট হওয়ার কথা ছিল ২৬ মার্চ। কিন্তু ২৪ মার্চ গোটা দেশ লকডাউনের আওতায় চলে যাওয়ায় ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়ে যায়। লকডাউন উঠতে শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশনও ভোটের দিন ঘোষণা করেছেন ১৯ জুন। স্থগিত থাকা ১৮ আসনের সঙ্গে ভোট হবে আরও ৬ আসনে। মোট এই ২৪ আসনের অধিকাংশতে জিততে বিজেপি মরিয়া। আধুনিক পরিভাষায় ‘হাইপার অ্যাকটিভ’। লোকসভার মতো রাজ্যসভাতেও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা তাদের চাই।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই নরেন্দ্র মোদির অন্যতম প্রধান ঘোষিত লক্ষ্য ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’ গঠন। কংগ্রেস দিন দিন দুর্বল হয়েছে। কিন্তু তবু শতাব্দীপ্রাচীন দলটির কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার চেষ্টা থেকে মোদির বিজেপি নিজেকে সরায়নি। মে মাসের প্রথম তিনটি সপ্তাহ করোনাকে উপেক্ষা করার কারণও ছিল ওই কংগ্রেসকে আরও হীনবল করা। ২০ মে পর্যন্ত তাদের ‘প্রায়োরিটি’ ছিল মধ্য প্রদেশ রাজ্যে সরকার দখল। সমর্থকসহ কংগ্রেসের জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে ভাঙিয়ে মধ্য প্রদেশ কবজা করার দুদিনের মাথায় ঘোষিত হয় জনতা কারফিউ। তার দুদিন পর লকডাউন। এবার রাজ্যসভার ভোটের দিন নতুন করে জানাজানি হতেই বিজেপির নজরে ঘুরপাক খাচ্ছে গুজরাট। ওই রাজ্য থেকে কংগ্রেসকে দ্বিতীয় আসন জিততে না দিতে দল ভাঙানোর চেনা রাস্তায় আরও একবার হাঁটতে শুরু করেছে মোদি-অমিত শাহের বিজেপি। ৪ কংগ্রেস বিধায়ককে তারা বাধ্য করেছে দলত্যাগে।
মোদি-শাহর নিজের রাজ্য গুজরাটে সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে ১৮২ আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ৯৯টি আসন, কংগ্রেস ৭৭। সেই থেকে ক্রমেই বিজেপি যেমন তার শক্তি বাড়িয়েছে, তেমনই পদত্যাগ করিয়ে শক্তি কমিয়েছে কংগ্রেসের। এই মুহূর্তে বিধানসভায় কংগ্রেসের সদস্যসংখ্যা ৬৫। বিজেপির ১০৩। ভোট হবে ৪ আসনে। জেতার জন্য এক-একজন প্রার্থীর প্রয়োজন ৩৭টি প্রথম পছন্দের ভোট। দলত্যাগীদের সংখ্যা না বাড়লে কংগ্রেস সহজেই দুটি আসন জিতে নিতে পারত, বাকি দুই আসন পেত বিজেপি। কিন্তু মোদি-রাজ্যে কংগ্রেসকে সূচ্যগ্র মেদিনী ছেড়ে দিতে বিজেপির অনীহা তীব্র। বিস্ময় এটাই, মধ্য প্রদেশ হারানোর পরেও কংগ্রেসের টনক নড়ল না! চার বিধায়কের ইস্তফার পর এখন কংগ্রেস ৬৫ জন সদস্যকে ধরে রাখতে উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। তৃতীয় আসন জেতার লক্ষ্যে বিজেপি অনেকটাই এগিয়ে গেছে।
কান্ডারিহীন কংগ্রেসের কাছে কিল খেয়ে তা হজম করা ছাড়া উপায় নেই। গুজরাটের ধাক্কা সামলাতে তাই তারা কর্ণাটকের দিকে ঝুঁকেছে। রাজ্য বিধানসভায় তাদের সদস্যসংখ্যা ৬৫। প্রতিটি আসন জিততে প্রয়োজন ৪৫ ভোট। বাড়তি ২০ ভোট কংগ্রেস দিতে চাইছে জেডিএসের নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়াকে, যাতে বিজেপি বাড়তি একটা আসন জিততে না পারে।
করোনার দরুন গোটা দেশে সামাজিক ক্ষোভ চূড়ান্ত। জীবন ও জীবিকার সংশয়ে দুলছে প্রত্যেক মানুষ। অর্থনীতি তলানিতে। হাহাকার সর্বত্র। মোদির জনপ্রিয়তায় বড় রকম টোলও খেয়েছে। অথচ তা সত্ত্বেও রাজনীতির ‘কোর ইস্যুগুলোর’ একটাও বিজেপি ছাড়ছে না। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণে যা কিছু করণীয় তারা করে চলেছে। আগামী বুধবার, ১০ জুন, ‘রামজন্মভূমি’ চত্বরের কুবের টিলামন্দিরে প্রথম অনুষ্ঠান হতে চলেছে। ‘ভগবান শিবের’ বিশেষ পূজা ‘রুদ্রাভিষেক’-এর মাধ্যমে শুরু হবে মন্দির স্থাপনের প্রথম কাজ। রামমন্দির ট্রাস্টের সভাপতি মহান্ত কমল নয়ন দাস সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ভগবান শিবের পূজা করে রামচন্দ্র তাঁর দিন শুরু করতেন। রামমন্দির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমরা সেই ঐতিহ্যই বজায় রাখছি।’ ২০২৪ সালের ভোটে অযোধ্যার রামমন্দিরই তাদের তুরুপের তাস হবে বলে বিজেপির ধারণা।
ফেব্রুয়ারির শেষ ও মার্চের গোড়ায় দিল্লি দাঙ্গা বিজেপিকে বিব্রত রেখেছিল। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির উদ্যোগ ছিল ওই দাঙ্গার অন্যতম প্রধান ইন্ধন। এর আগে থেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বিজেপি ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিরোধীদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করে গেছে। তাদের কণ্ঠে জন্ম নিয়েছে ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ বা ‘খান মার্কেট গ্যাং’ ‘লুটেন্স দিল্লিবালা’ জাতীয় শব্দবন্ধ। শাহিনবাগ আন্দোলনের পেছনেও তারা এই জনগোষ্ঠীর ‘হাত’ দেখতে পেয়েছে। অনেক আগে থেকেই তাই তারা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয়। করোনাকাণ্ড সত্ত্বেও সেই লক্ষ্য থেকে বিজেপি পিছু হটেনি। দেশদ্রোহের মামলা এখন মুড়ি-মুড়কির মতো সহজলভ্য। চার্জশিট দাখিল শুরু হয়ে গেছে।
শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনী প্রস্তুতিও। সবার চেয়ে এগিয়ে তারাই। করোনা মোকাবিলার ব্যস্ততার মাঝেও বিহার নির্বাচনের ঢাকে প্রথম কাঠি মারলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। গত রোববার দিল্লি থেকে ‘ভার্চ্যুয়াল’ জনসভা করে ভিডিও মারফত সবাইকে জানিয়ে দিলেন, অক্টোবরে বিহার নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারকে সামনে রেখেই তাঁরা আরও একবার ক্ষমতায় আসবেন। এবং এবার আসবেন দুই–তৃতীয়াংশ শক্তি নিয়ে।
এই বছরে বিহার এবং আগামী বছরে পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু বিজেপির মাছের চোখ। ভাগ্যের ওপর কোনো কিছু ছেড়ে দিতে মোদি-জমানার বিজেপি মোটেই রাজি নয়। কংগ্রেসসহ বাকি বিরোধী দলের সঙ্গে তাদের পার্থক্য এখানেই। বছরে ১২ মাস ৩৬৫ দিনই তাই তারা সক্রিয়। বিন্দুমাত্র ঢিলেমি নেই। প্রচলিত বাক্যটা তাই ‘মোদি অ্যাক্টস, আদার্স রিঅ্যাক্ট’।