স্টাফ রিপোর্টার : করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দেশে এলাকাভিত্তিক লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সংক্রমণের হার বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যেকটি এলাকাকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন- এই তিন জোনে ভাগ করা হয়েছে।
জানা গেছে, বিভিন্ন জোনে বিভক্ত ওইসব এলাকায় কী কী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে একটি রূপরেখা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্য বিভাগের ওই রূপরেখাটি গতকাল রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পরই অঞ্চলভিত্তিক এই রূপরেখা বাস্তবায়ন করা হবে। বিশেষ করে রেড জোনে প্রাথমিকভাবে ২১ দিন লকডাউন করার চিন্তাভাবনা চলছে। সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পরেই এলাকাভিত্তিক লকডাউন কার্যক্রম শুরু করা হবে। এর আগে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে একাধিক সভা হয়েছে। সেই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য পাঠানো হয়েছে। এই প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই করে প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। এর পরই এটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু হবে।
রাজধানীতে রেড জোন : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, প্রস্তাবনায় রাজধানীর ১০টি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই এলাকাগুলো হলো- গুলশান, কলাবাগান, গেন্ডারিয়া, পল্টন, সূত্রাপুর, রমনা, মতিঝিল, তেজগাঁও, শাহজাহানপুর ও হাজারীবাগ।
কাল মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকার রাজাবাজার ও ওয়ারীতে পরীক্ষামূলকভাবে লকডাউন করা হতে পারে। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, দিনক্ষণ সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পেলে চলতি সপ্তাহ থেকে এটি কার্যকর করা হবে। প্রথমে সর্বোচ্চ সংক্রমিত রাজধানী ঢাকা থেকে এলাকাভিত্তিক রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে ভাগ করে কার্যক্রম শুরু হবে।
এর পর পর্যায়ক্রমে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের সব জেলা-উপজেলা এ কার্যক্রমের আওতায় আসবে। আজ সোমবারের মধ্যে এটি কার্যকর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। এর পরই এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
জোন ভাগের প্রক্রিয়া : সারাদেশকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করার প্রক্রিয়া নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে গত কয়েক দিন দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জোনভিত্তিক কার্যক্রম নিয়ে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, প্রতি লাখে সংক্রমণের হার কত হলে তা কোন জোনে ভাগ করা হবে, তা চূড়ান্ত করা হয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে পৃথক সংক্রমণের হার বিবেচনায় নিয়ে জোনগুলো ভাগ করা হয়। সে অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৩০ জন আক্রান্ত হলে সেটিকে ‘রেড’ জোন ধরা হবে।
ঢাকায় রেড জোন ঘোষণার ক্ষেত্রে প্রতি লাখে আক্রান্তের সংখ্যা ৩০-এর পরিবর্তে ৪০ করার প্রস্তাব করেছেন বৈঠকে উপস্থিত বিশেষজ্ঞদের কয়েকজন। এ কারণে সারসংক্ষেপে ওই দুটি প্রস্তাবনার কথা উল্লেখ আছে। ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি লাখে ৩ থেকে ২৯ হলে সেটিকে ‘ইয়েলো’ জোন ধরা হবে। আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি লাখে শূন্য থেকে ২ হলে তা ‘গ্রিন’ জোন হিসেবে বিবেচিত হবে।
ঢাকার বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি লাখে ১০ জন হলে তা ‘রেড’ জোন বিবেচনা করা হবে। এ ছাড়া আক্রান্ত প্রতি লাখে ৩ থেকে ৯ জন হলে তা ‘ইয়েলো’ জোন এবং আক্রান্তের সংখ্যা শূন্য থেকে ২ জন হলে তা ‘গ্রিন’ জোন বলে বিবেচিত হবে।
জোনভিত্তিক কার্যক্রম : জোনভিত্তিক কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। জানা গেছে, রেড জোনে পুরোপুরি লকডাউন করা হবে। সেখান থেকে কেউ বাইরে যেতে পারবেন না। আবার বাইরে থেকে কেউ ওই এলাকায় প্রবেশও করতে পারবেন না। তবে এ জোনে জরুরি সেবা কার্যক্রম চলবে। ওষুধের দোকান, খাবার হোটেল, স্টেশনারি-মুদি দোকান খোলা থাকবে।
এই এলাকার মধ্যে সংবাদপত্র অফিস থাকলে তা চালু থাকবে। তবে খাবার হোটেলে বসে কেউ খেতে পারবেন না। পারসেল নিতে পারবেন। এর বাইরে ওই এলাকায় থাকা সব অফিস বন্ধ থাকবে। রেড জোনে বসবাসকারীরা অনলাইনের মাধ্যমে অফিস কার্যক্রম পরিচালনা ও দায়িত্ব পালন করবেন। এ জোনের সবার নমুনা পরীক্ষা করা হবে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশন এবং তার কন্টাক্ট ট্রেসিং করে অন্যদের কোয়ারেন্টাইন করা হবে। ওই এলাকার দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষকে সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হবে।
ইয়েলো জোনও অবরুদ্ধ থাকবে। তবে অফিস-আদালত চালু থাকবে। ইয়েলো জোনে বসবাসকারীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়ের জন্য আইডি কার্ড প্রদর্শন করে বের হতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে পরিবারের একজন সদস্য বাইরে বের হবেন। তবে ইয়েলো জোন থেকে রেড জোন কিংবা দেশের অন্যত্র চলাচল করতে পারবেন না। এই জোনেও ছিন্নমূল ও দরিদ্রদের খাবার সহায়তা প্রদান করা হবে। গ্রিন জোনে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলবে।
তবে রেড ও ইয়েলো জোন থেকে কাউকে ওই গ্রিন জোনে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে গ্রিন জোন থেকেও কেউ রেড ও ইয়েলো জোনে প্রবেশ করতে পারবেন না। গ্রিন জোনে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনের পাশাপাশি তার কন্টাক্ট ট্রেসিং করে দ্রুত কোয়ারেন্টাইন করা হবে, যাতে সংক্রমণ অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে।
এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, পুরো প্রক্রিয়ার একটি কার্যক্রম চূড়ান্ত করে তা প্রস্তাব আকারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত এলে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
আক্রান্ত শনাক্তকরণ ও গতিবিধি অ্যাপসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে :আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তকরণ ও তাদের চলাচল অ্যাপসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এ জন্য একটি বিশেষ সফটওয়ার তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এলাকার মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী কোনো ব্যক্তি অন্যত্র চলাচল করলে ওই অ্যাপসে তা ধরা পড়বে। ওই অ্যাপস ব্যবহার করে এলাকাভিত্তিক আক্রান্তদের একটি ম্যাপিং তৈরি করা হবে। রাজধানী ঢাকায় এই ম্যাপিংয়ের কাজ শেষ করা হয়েছে। এখন নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় ম্যাপিংয়ের কাজ চলছে।
এ বিষয়ে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আইসিটি বিভাগের সহায়তায় সংক্রমণের ম্যাপিং করে জোনভিত্তিক এলাকাগুলোকে ভাগ করা হয়েছে। ডিজিটাল মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী সবাই এর আওতায় এসেছে। এ ছাড়া অ্যানালগ ফোন ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে বিটিআরসি নজরদারি করছে। সুতরাং মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই ব্যক্তির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দ্রুত কার্যকরের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের : এলাকাগুলোকে ভাগ করে করোনা প্রতিরোধে সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এটি দ্রুত কার্যকরের তাগিদ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সংক্রমণ প্রতিরোধে উদ্যোগটি অন্ত্যন্ত ভালো। কিন্তু ফল নির্ভর করবে কার্যকরের ওপর।
কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা তেমন ভালো নয়। সরকার ছুটি ঘোষণার পর হাজার হাজার মানুষ দল বেঁধে গ্রামে চলে গিয়েছিল। ঈদের সময়েও হাজার হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করেছে। এতে প্রতিরোধ কার্যক্রম সফল হয়নি। এবার আশা করি, সরকার দ্রুত এবং কঠোরভাবে প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করবে। তাহলে সুফল মিলবে।
চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, ঢিলেঢালা কর্মসূচি দিয়ে করোনা প্রতিরোধে সফলতা আসবে না। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে কঠোরভাবে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। শুরুর দিকে সংক্রমিত জোন টোলারবাগ ও শিবচরে লকডাউন দেওয়া হয়েছিল। এই দুই এলাকায় কার্যকর লকডাউনের কারণে সংক্রমণ বাড়েনি। টোলারবাগ ও শিবচরকে আদর্শ ধরে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা গেলে সুফল মিলবে।
লাইট নিউজ