মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ০৭:৪০ অপরাহ্ন

ভারতকে চাপে রেখে ক্ষমতা দেখাচ্ছে চীন

লাইটনিউজ রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : বুধবার, ১০ জুন, ২০২০

শুধু করোনাভাইরাসই যে একমাত্র হুমকি হয়ে এ বছর ভারতের সীমান্তে ঢুকে পড়েছে, তা নয়। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির হিমালয়সংলগ্ন বিতর্কিত লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) এলাকায় ভারতীয় জমিতে চীনের সেনারা ঢুকে পড়েছে। তারা এলএসিতে ‘উল্লেখযোগ্যসংখ্যক’ সেনা মোতায়েন করেছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ ও সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত এই সীমান্ত এলাকার চারটি পয়েন্টে বহুদিন ধরেই চীন হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। এই পয়েন্টগুলো সিকিম ও কাশ্মীর উপত্যকার উত্তর–পূর্ব অঞ্চলের লাদাখ এলাকায়। কোনো সরকারই এ কথা অস্বীকার করেনি যে ভারত তাঁর নিজ ভূখণ্ড বলে যে সীমানাকে দাবি করে থাকে, সেই সীমানায় চীন দখলদারি করছে।

১৯৬২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে এই ইস্যুতেই যুদ্ধ হয়েছিল। অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের হলেও এই যুদ্ধ বেশ রক্তক্ষয়ী হয়েছিল এবং তাতে ভারতের পরাজয় হয়েছিল। তারপর থেকে অর্ধশত বছর ধরে দুই দেশের সেনারা সেখানে অস্বস্তিকর অবস্থায় থাকলেও বিবাদে জড়ায়নি।

১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত সেখানে কোনো গুলি চলেনি। কিন্তু কোনো পক্ষ গুলি না চালালেও প্রতিবছর এলএসিতে অন্তত চার শ অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটে। তবে দ্রুতই তা মিটিয়ে ফেলা হয়। তবে এবারের অবস্থা ভিন্ন। চীন নিজেই যে অংশকে ভারতের ভূখণ্ড বলে স্বীকার করে নেয়, এবার সেই অংশেও তারা ঢুকে পড়েছে। ভারতীয় ভূখণ্ডে তারা যে শুধু টহল দিচ্ছে, তা নয়; তারা পেনোং সো লেকের কাছের ভারতীয় ভূখণ্ডে তাদের স্থায়ী উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য বিশাল বিশাল তাঁবু খাটিয়েছে, কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করেছে, এমনকি কয়েক মাইলজুড়ে রাস্তাও বানিয়েছে।

চীনের এই সীমান্ত লঙ্ঘন অবশ্যই বাধার মুখে পড়ার কথা এবং তাদের বাধা দেওয়াও হয়েছে। গত মাসেই অন্তত দুবার চীনা এবং ভারতীয় সেনাদের মধ্যে হাতাহাতি-ধস্তাধস্তি ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। দুই পক্ষেরই কয়েক ডজন সেনা আহত হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। যদিও ২০১৭ সালে ভুটানের দোকলামে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু সেটি ছিল তৃতীয় কোনো দেশের ভূখণ্ড। আর এবার চীন সরাসরি ভারতের মাটিতে ঢুকে পড়েছে। তাকে প্রতিহত করার যথেষ্ট কারণ ভারতের রয়েছে।

এটি সত্য, দোকলামের উত্তেজনা প্রশমনে চীনের নমনীয়তাই প্রধান ভূমিকা রেখেছে। ২০১৪ সালে যেভাবে ভারতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের প্রথম সফরের সময় লাদাখে উদ্ভূত একই ধরনের উত্তেজনা স্তিমিত হয়েছিল। কিন্তু এই ২০২০ সালের চীন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিধর ও উদ্ধত। আমেরিকার শক্তির সঙ্গে তাঁর শক্তির তুলনা করা হচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে দেশটি নিজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবে, সেটা মনে করা কঠিন। ভারতে চীনের এই আগ্রাসনের বিষয়টি বিশ্বনেতারা দেখছেন। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এ নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছেন। রাশিয়াও উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু চীন তাতে তেমন কোনো গা করছে না। চীন বিবৃতি দিয়ে বলেছে, এই পরিস্থিতি ‘মোটামুটি স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রিত’ অবস্থায় আছে।

এখন সমস্যা হলো, ভারতের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ চালানো কিংবা ভারতের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো সামরিক ক্যাম্পেইন চালানো চীনের উদ্দেশ নয়; বরং তারা ‘সালামি টেকনিক’ ব্যবহার করছে। এই টেকনিক অনুযায়ী চীন ছোট ছোট সেনাদল ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকিয়ে ভারতের প্রত্যুত্তরের ধরন পর্যবেক্ষণ করতে চাচ্ছে। যত দূর মনে হচ্ছে, চীন ভারতীয় ভূখণ্ডের কয়েক কিলোমিটার এলাকা দখল করে নেবে এবং তারপর শান্তির ঘোষণা দেবে। এটা নতুন কোনো কৌশল নয়। এই কৌশল দিয়েই চীন ভারতের মেজাজ পরীক্ষা করতে চাইবে। ভারত সরকার যেহেতু চীনের এই সামরিক আগ্রাসনকে শুইয়ে দেওয়ার কোনো ক্ষমতা রাখে না, সেহেতু দিল্লি এখন দীর্ঘমেয়াদি অনিষ্পন্ন পরিস্থিতির জন্য তৈরি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতীয়তাবাদী সরকার এখন চীনের সঙ্গে টক্কর দিতে গিয়ে নিজ দেশের জনগণের কাছে মুখ হারানোর ঝুঁকি নিতে চাইবে না। এ কারণে তারা এই ইস্যুকে সামনে আনার বিষয়েও আগ্রহী নয়। তারা সীমানা ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টিই সামনে রাখতে চায়।

চীন এসব তৎপরতার বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলতে পারে, এলএসি–সংলগ্ন এলাকায় ভারত যেসব স্থাপনা ও রাস্তাঘাট তৈরির কাজ করছে, তাতে একধরনের উসকানি ছিল। সেই উসকানি থেকেই চীন এমন তৎপরতা দেখাচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের কথা চীন বললেও তা ধোপে টিকবে না। কারণ, বহুদিন আগেই সীমান্তে ভারতের স্থাপনা গড়ার কথা ছিল। দুই বছর আগে ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় কমিটির (আমি তখন ওই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম) সদস্যরা ওই এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তাঁরা দেখে এসেছেন, সেখানে ভারতীয় ভূখণ্ডে স্থাপনা খুবই অপ্রতুল। অন্যদিকে সীমানার ওপারে চীন যানবাহন চলাচলের রাস্তাঘাট, রেললাইন, এমনকি বিমানবন্দর বানিয়ে ফেলেছে। আর এলএসির এ প্রান্তে চলাচলের ভালো রাস্তাঘাটও নেই।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, চীন ও ভারতের সম্পর্ক বরাবরই জটিল ধরনের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর দুই দেশের ক্ষোভ একেবারে উবে যায়নি। ভারতের সেই ক্ষত রয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্য ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে চীন থেকে ভারতের আমদানি অনেক বেশি। এত পরিমাণের বাণিজ্য হওয়ার পরও চীন ভারতের বন্ধু হতে পারেনি। তারা পাকিস্তানকে কাশ্মীর সীমান্তে উত্তেজনা ছড়াতে সহায়তা করছে। সি চিন পিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের মূল রাস্তা পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে যাবে। এসব বিষয় অবশ্যই ভারতকে চীনের চাপে রাখার কৌশল। এই চাপ চীন অব্যাহত রাখবে। ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশকে চীন প্রথম থেকেই নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে থাকে এবং এলাকাটিকে তারা ‘দক্ষিণ তিব্বত’ নাম দিয়েছে। চীন এই এলাকার মালিকানার দাবি আগের চেয়ে বাড়াতে পারে বলে মনে হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, চীন হঠাৎ করে এমন আগ্রাসী আচরণ করছে কেন? আসলে এর পেছনে চীনের আরও অনেক বড় উদ্দেশ্য আছে। সে তার সীমান্তসংলগ্ন দেশের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করে বিশ্বকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের প্রভাব দেখাতে চাচ্ছে। সে বোঝাতে চাচ্ছে, ট্রাম্পের ধমকের পরোয়া তারা করে না। একই সঙ্গে ভারতকে চাপে রেখে এশিয়ার অন্য দেশগুলোকেও তারা ভয় দেখানোর কাজটি সেরে ফেলতে চাচ্ছে। ভারতের দিক থেকে বলা হয়েছে, চীনের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়েছে এবং সেখানে উভয় পক্ষ শান্ত থাকবে বলে অঙ্গীকার করেছে এবং এ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে চীনা সেনাদের গুটিয়ে নেওয়া হবে কি না, সে বিষয় চুক্তিতে আছে কি না, তা এখনো জানা যায়নি।

এখন এটি পরিষ্কার যে সীমানা ইস্যুতে চীন ও ভারতের একটি স্থায়ী শান্তিচুক্তিতে আসা দরকার। চীন সব সময় বলে এসেছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভালোর জন্য একটি আনুষ্ঠানিক সীমানা নির্ধারণে পৌঁছানো দরকার। এখন চীন যত শক্তিধর হচ্ছে, তত সেই ভাবনা থেকে সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ভারতকে চাপে রাখার মোক্ষম কৌশল হিসেবে এটিকেই তারা ব্যবহার করে যাবে। চীনের পক্ষ থেকে এত দিন বলা হচ্ছিল, তারা ‘শান্তিপূর্ণ উত্থানে’ বিশ্বাস করে। কিন্তু সেই ধারণা এখন বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।

আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2020 Lightnewsbd

Developer Design Host BD