করোনা মহামারির মাঝেই এসেছে মধুমাস। ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে ঘরবন্দি মানুষ। স্থবির জনজীবন। সব কিছুই যেন থমকে গেছে। কিন্তু প্রকৃতি চলেছে তার আপন নিয়মেই। গাছে গাছে ফলেছে মৌসুমি সুস্বাদু নানা ফল। চির আকাঙ্ক্ষিত এই মধুমাসে সুস্বাদু নানা ফলের স্বাদ নিতে মুখিয়ে সবাই। ফল চাষিরাও প্রস্তুত তাঁদের উৎপাদিত ফল ভোক্তার হাতে তুলে দিতে। কিন্তু এখানেও বাদ সেধেছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। জ্যৈষ্ঠে মিষ্টিমধুর আম, লিচু সঠিকভাবে বাজারজাত করা সম্ভব হবে, নাকি গাছেই পচবে—এমন শঙ্কা ফল চাষিদের। তাঁদের পাশাপাশি দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, বিক্রেতা সবাই।
প্রতিবছরই দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে আম রপ্তানি হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এবার আম রপ্তানি প্রায় অসম্ভব। চাষিরা বলছেন, আম ও লিচু বাজারজাতকরণে তাঁরা ক্রেতা পাচ্ছেন না। ফল বাজারজাতকরণে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তাঁরা শুনেছেন। কিন্তু গাছে ফল পাকা শুরু করলেও এখন পর্যন্ত সরকারি পর্যায় থেকে তাঁদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি। এ অবস্থায় ফল বাজারজাতকরণ নিয়ে তাঁরা শঙ্কায় আছেন।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গত ১৬ মে তাঁর মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষ থেকে জানান, করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আম, লিচুসহ মৌসুমি ফল ও কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ কিভাবে করা যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অনলাইনে (জুম প্ল্যাটফর্মে) আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। উপস্থিত কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টরা আম ও লিচুসহ মৌসুমি ফল বাজারজাতকরণে ১০ দফা সুপারিশ করেন। মন্ত্রী বলেছিলেন, আম ও লিচু ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।
কৃষিমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ‘ফুড ফর নেশন’ উদ্বোধন হলেও নিশ্চিত করা যায়নি কৃষিপণ্যের সঠিক বিপণন ও ন্যায্য মূল্য। অথচ চাহিদা মোতাবেক সহজলভ্যতা তৈরি এবং জরুরি অবস্থায় ফুড সাপ্লাই চেইন অব্যাহত রাখতেই বাংলাদেশে প্রথম উন্মুক্ত কৃষি মার্কেট অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ফুড ফর নেশন’ চালু করা হয়। এর মাধ্যমেই সরকার আম ও লিচুর বাজারজাতকরণের সরবরাহ ঠিক রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তার সঠিক বাস্তবায়ন নেই বলে অভিযোগ চাষিদের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষি আক্তার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গাছে আম পেকে যাচ্ছে এখনো কোনো বেপারি এদিকে আম কিনতে আসেনি। বেপারিরা এলে না হয় ১০ টাকার জিনিস সাত টাকা হলেও বিক্রি করতে পারতাম। প্রতিবছর দেশের বাইরে আম যেত, আমরাও ভালো দাম পেতাম। বিদেশে পাঠানোর জন্য যারা মাল নিত বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তারাও যোগাযোগ করেনি আমাদের সঙ্গে। শুনেছি সরকারের পক্ষ থেকে আম ও লিচু বাজারে বিক্রি করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি।’
রাজশাহীর আম চাষি আলতাব হোসেন বলেন, ‘ঝড়ের কারণে আমের কোয়ালিটি খারাপ, রং কালো হয়ে গেছে। আম বিক্রির জন্য আগের মতো পাইকারও পাচ্ছি না। বড় পাইকাররা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার জন্য বাগান বুকিং দিয়ে যেত, কিন্তু এ বছর দেশের বাইরেও যাচ্ছে না আম।’
দিনাজপুরের লিচু চাষি মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘অতীতে প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকার এসে বাগানের লিচু কিনে নিত। করোনার কারণে তারা না আসায় আমরা লিচু বিক্রি করতে পারছি না। লিচু খুব কম সময়ের জন্য বাজারে আসে। লিচু গাছে পাকা শুরু করলে তা সময়মতো বিক্রি করতে না পারলে সব নষ্ট হয়ে যায়। লিচু গাছের বোঁটা থেকে ঝড়ে যায়। এখন বাগানে লিচু পেকে আছে, কোনো পাইকার পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও কালবৈশাখীতে অনেক বাগানেরই ৪০ শতাংশ লিচু পড়ে গেছে। সব মিলিয়ে এ বছর খুবই ক্ষতির মুখে পড়েছি।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিরুজ্জামান অবশ্য ফল চাষিদের অভিযোগ মানতে নারাজ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, “উন্মুক্ত কৃষি মার্কেট অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ফুড ফর নেশন’-এর মাধ্যমে আম কেনাবেচা হচ্ছে। আপনি যে চাষিদের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরা হয়তো বিষয়টি জানেন না। এরই মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয় কৃষিপণ্য পরিবহনে ২৫ শতাংশ ভাড়া কমিয়ে দিয়েছে। সরকারিভাবে ত্রাণের সঙ্গে আম কিনে দেওয়া হচ্ছে। এলাকায় এখন আমের ভালো দাম আছে। আম, লিচুসহ মৌসুমি ফল বাজারজাতকরণে নেওয়া ১০টি সিদ্ধান্ত ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হবে। একই সঙ্গে সব বাস্তবায়িত হবে—এ রকমটা আমরাও আশা করি না।”
এদিকে গত ২৮ মে দেশের ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে আম ও লিচু বরাদ্দ দিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, ত্রাণসামগ্রী হিসেবে শাকসবজি, আম ও লিচু কিনে বিতরণ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রত্যেক ত্রাণ গ্রহণকারীকে কমপক্ষে পাঁচটি করে গাছ লাগানোর অনুরোধ করা যেতে পারে।
লাইটনিউজ/এসআই