চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে দেশের জাহাজ মালিকরা। গত তিন মাস ধরে শত শত জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে বসে আছে। এতে দেশের জাহাজ মালিকদের ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছে। অন্যদিকে গুটি কয়েক পণ্যের এজেন্ট ও জাহাজ মালিক সিরিয়াল ও ডব্লিউটিসি’র ছাড়পত্র ছাড়া প্রতি মাসে প্রতিনিয়ত ট্রিপ বাগিয়ে নেয়ায় মূল জাহাজ মালিকরা ট্রিপ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিভোয়া) এর নের্তৃবৃন্দ।
ফলে নৌ-যান ব্যবসা রক্ষায় সম্মিলিত সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছে বিসিভোয়া। শনিবার কাওরানবাজারে এস এস রহমান গ্রুপের কর্যালয়ে এক মতবিনিময় সভা শেষে এ কমিটি ঘোষণা করা হয়।
ঘোষিত কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সাবেক এস.পি. মাহবুব উদ্দীন আহমেদ (বীর বিক্রম), আহবায়কের দায়িত্বে বিশিষ্ট জাহাজ ব্যবসায়ী মোঃ ইকবাল হোসেন, সদস্য সচিবের দায়িত্বে বিশিষ্ট জাহাজ ব্যবসায়ী ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করবেন এস এস রহমান গ্রুপের চেয়ারম্যান মোঃ রকিবুল আলম (দিপু)।
মতবিনিময় সভায় জাহাজ মালিকরা অভিযোগ করেছেন, কতিপয় বিপথগামী নেতৃবৃন্দ ডব্লিউটিসিকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। ডব্লিউটিসিকে পাশ কাটিয়ে কিছু সংখ্যক বিপধগামী নেতৃবৃন্দের সহায়তায় ডব্লিউটিসি’র অনুমোদিত জাহাজ বসিয়ে রেখে তাদের নিজস্ব জাহাজ ও তাদের মনোনীত লোভী জাহাজ মালিকদের মাধ্যমে সরাসরি সিরিয়াল ব্যতীত ট্রিপ দিচ্ছে, যার ফলে সাধারণ জাহাজ মালিকদের সিরিয়াল এখন প্রায় ৮০০ জাহাজ এর উপরে। তাদের লোভী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে পণ্য পরিবহণে অচিরেই ডব্লিউটিসি’র মাধ্যমে অর্জিত সাফল্য ভেঙ্গে পরবে এবং দেশে নৌ-পথে অরাজকতা সৃষ্টি হবে যা কখনো ভোক্তা অধিকার ও ন্যায্যতা থাকবে না। নিয়ম অনুযায়ী ডব্লিউটিসি’র ছাড়পত্রের মাধ্যমে সিরিয়াল অনুযায়ী পণ্য পরিবহন করা হত এতে জাহাজ মালিকরা মাসে অন্তত ১/২ টি ট্রিপ পেত। কিন্তু বর্তমানে ডব্লিউটিসি কনভেনার ও কো-কনভেনার এবং কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের সেচ্ছা চারিতায় এবং কতিপয় ৪/৫ জন পণ্যের এজেন্টদের দূর্নীতি ও লোভের কারণে জাহাজ মালিকরা ৩ মাসেও একটি ট্রিপ পাচ্ছে না। ৩ মাস পরে ১টি ট্রিপ পেলেও সেই জাহাজের ভাড়া পণ্যের এজেন্টরা দিতে গড়িমসি করে পরিশোধ করেন। ফলে ৪/৫ জন পণ্যের এজেন্ট ও জাহাজ মালিক সিরিয়াল ও ডব্লিউটিসি’র ছাড়পত্র ব্যাতিত প্রতি মাসে প্রতিনিয়ত ট্রিপ বাগিয়ে নিচ্ছেন। তারা ডব্লিউটিসি’র ছাড়পত্র তোয়াক্কা না করে পণ্য পরিবহন করছেন।
মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের জানানো হয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও স্থল, আকাশ ও নৌ-পথ দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। এরমধ্যে সমুদ্র বন্দর নৌ-পথ দিয়েই দেশের ৮০% পণ্য পরিবহন করা হয়। নৌ-সেক্টরে অন্তত পঁচিশ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা আছে। এছাড়া, প্রতি বছর বিপুল পরিমান রাজস্ব সরকারী কোষাগারে এই সেক্টর থেকে জমা করে দেশের উন্নয়নে আমরা অংশ গ্রহণের চেষ্টা করছি।
এই সেক্টরের মাধ্যমে প্রতি বছর দেশের মোট পণ্যের প্রায় ২.৫ কোটি মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করা হয় উল্লেখ করে আরো বলা হয়, এর একটি বড় অংশ প্রায় ৬০% পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পরিবহন করা হয় বিভিন্ন নৌ-যান এর মাধ্যমে।
এই সেক্টরে ছোট বড় প্রায় ৫,০০০ (পাঁচ হাজার) এর অধিক নৌ-যান (জাহাজ) চলাচল করছে। দেশের অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ন এই সেক্টরটি, কিন্তু ডব্লিউটিসি’র কিছু অযোগ্য, অসাধু নেতৃবৃন্দ ও কর্মকর্তাদের কুকর্ম ও দুর্নীতির কারণে আজ জাহাজ মালিকরা প্রায় পথে বসে গেছে।
মতবিনিময় সভায় আরো অভিযোগ করা হয়, ডব্লিউটিসি কনভেনার ও কো-কনভেনার এর ব্যর্থতা ও দূর্নীতি করে বেআইনী ভাবে বাল্কহেডের মাধ্যমে বহিঃনোঙ্গর থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহন করার সুযোগ দিচ্ছেন যা ডব্লিউটিসি’র নীতি বিরোধী এবং এর কোন বিধি বিধান নেই, ঝুকিপূর্ণ বাল্কহেড গুলিতে প্রশিক্ষিত কোন মাষ্টার ড্রাইভার থাকে না। এসকল বাল্কহেডগুলির গঠন কাঠামো সমুদ্রে চলাচলের জন্য অত্যান্ত ঝুকিপূর্ণ। এই বাল্কহেডগুলি লোড দিয়ে পণ্যের এজেন্ট ও মেয়াদ উত্তীর্ন কনভেনার ও কো-কনভেনার কমিশন হাতিয়ে নিচ্ছেন। বাল্কহেড এর বহিঃনোঙ্গর হতে পণ্য পরিবহন করার কোন অনুমোদন নেই। তারপরেও ডব্লিউটিসি কনভেনার ও কো-কনভেনার এর দুর্নীদিও কারণে বাল্কহেড সরাসরি পণ্য পরিবহণ করছে।
ফলে অধিকাংশ জাহাজ মালিক ব্যাংক ঋণ এর মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করেন যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন তারা সময় মত ব্যাংক এর ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। ব্যাংকের তাগাদায় আজ তারা দিশেহারা ও ঋণ খেলাপী হয়ে যাচ্ছেন। এয়াড়া, বিশৃঙ্খল ভাবে পণ্য পরিবহনের কারনে নৌ-পথের ডাকাতির সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে এবং এই ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা লগ্নীকৃত জাহাজ মালিক ও নৌ-শ্রমিক ভাইয়েরা নির্বিঘ্নে তাদের জাহাজে ডিউটি করতে পারছে না এবং নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছেন ও প্রতিনিয়ত দূর্ঘটনার কবলিত হচ্ছেন। এতে জাহাজ মালিকরা হচ্ছেন সর্বশান্ত এবং জান মালের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে।
বর্তমানে প্রায় ৮০০ টি লাইটার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে অলসভাবে বসে আছে ও প্রায় ৪৫০টি জাহাজ বিভিন্ন গন্তব্যে মাল খালাসের অপেক্ষায় আছে এবং প্রায় ৩০০ জাহাজ অনিশ্চিত ডকে বসে প্রহর গুনছে। এমতাবস্থায় সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েক দফা দাবি জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে। অনতি বিলম্বে সরকারী গেজেট ২০১৪ সালের বাস্তবায়ন ও কার্যকর করার দাবী জানাচ্ছি। ডব্লিউটিসি’র সিরিয়ালের মাধ্যমে জাহাজ পণ্য লোড আনলোড করতে হবে। সমস্ত লাইটার ভেসেল এই সিরিয়াল থেকে ডব্লিউটিসি’র মাধ্যমে পরিবহন করার দাবী জানাচ্ছি। এই পর্যন্ত কার্গো মালিকদের পাওনা ও ডেমারেজ বিল অতিসত্তর হালনাগাদ করার জন্য পণ্যের মালিকদের অনুরোধ করা হয়। কার্গোতে যে সকল শ্রমিক কাজ করে তারা আমাদের পরিবারভুক্ত। কিন্তু কার্গো মালিকদের উপার্জন না থাকলে মালিকগণ ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও যথাযথভাবে শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করতে পারছেন না। সে জন্য আমাদের প্রস্তাব পণ্যের মালিকদের নিকট পণ্যের সকল বকেয়া ভাড়া পরিশোধ করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। বহিঃনোঙ্গর হতে বাল্কহেডে পণ্য পরিবহণ বন্ধ করার দাবী জানাচ্ছি। চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিকতা রক্ষার স্বার্থে এখনই তা বন্ধ করতে হবে।
যারা ডব্লিউটিসি’র সিরিয়াল বহিঃভ‚ত ভাবে পণ্য পরিবহণ করছেন তাদের পণ্যের এজেন্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ডব্লিউটিসি’র গেজেট অনুযায়ী ডব্লিউটিসি’র অযোগ্য নেতৃবৃন্দের মেয়াদ উত্তীর্ন কমিটি ভেঙ্গে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নতুন কমিটি তৈরি করে ডব্লিউটিসিকে ঢেলে সাজাতে হবে। সভায় সরকারের প্রধান মন্ত্রী, নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী, বানিজ্য মন্ত্রী ও ডিজি শিপিং এর ডি.জি ও চট্টগ্রাম পোর্টের চেয়ারম্যানকে আশু পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানানো হয়। মতবিনিময় সভায় অর্ধশত জাহাজ মালিক উপস্থিত ছিলেন।